যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে by মিনাম শাহ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির বেশির ভাগ সময়ই দক্ষিণ এশিয়া, এ বছরের শুরু পর্যন্ত, শান্ত ছিল। এ সময়ে এ অঞ্চলের দুই প্রধান যুদ্ধংদেহী প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান তো পারমাণবিক যুদ্ধের ভিতর প্রায় প্রবেশ করেছিল। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আধা সামরিক বাহিনীর একটি ঘাঁটিতে আত্মঘাতী হামলার পর দুই দেশের মধ্যে আকাশপথে ‘ডগফাইট’ হয়। এর ফল হিসেবে ভারতীয় একজন পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান। পরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। সীমান্তের ওপাড় থেকে কিভাবে সন্ত্রাসীদের হামলায় মদত দেয়া হচ্ছে, তার জবাবে ভারত কি অবস্থান নেবে, এই এপিসোডটি তারই একটি বড় বার্তা বহন করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়েছিল সে সময়ের পর এবারই প্রথম সীমান্ত অতিক্রম করেছে ভারতীয় যুদ্ধবিমান। আর তা বোমা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানের মূল ভূখন্ডে।
স্বভাবতই, এটা প্রত্যাশা করা হচ্ছিল, এ অঞ্চলে বিরোধ নিস্পত্তিকারী যুক্তরাষ্ট্র এই উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা করবে। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকের শুরুর পর থেকে এবারই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র এই সঙ্কট সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখে নি।
এর আগে ১৯৯০ সালে যখন কাশ্মীরে সবেমাত্র বিদ্রোহ এবং একটি সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে তখন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ দক্ষিণ এশিয়ায় তার সিআইএ পরিচালককে পাঠিয়েছিলেন আঞ্চলিক নেতাদের মাথা ঠান্ডা করতে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর এক বছর পর ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ বন্ধে এককভাবে বিশাল প্রভাব বিস্তার করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। একইভাবে ২০০১-২০০২ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ওই সময় ভারতীয় পার্লামেন্টে হামলার পর দুই দেশই তাদের সেনাদের মোতায়েন করতে থাকে। তখন ১০ মাস স্থায়ী সেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার ইতি ঘটাতে মধ্যস্থতা করে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন।
মধ্যস্থতাকারী হিসেবে (বাফার) আমেরিকার ভূমিকা দৃশ্যত স্থায়ী হয়ে ওঠে যখন তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস পরিমড়ি করে এ অঞ্চলে ছুটে আসেন ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর একটি সম্ভাব্য সামরিক যুদ্ধ প্রতিরোধে। যুক্তরাষ্ট্র শুধু যুদ্ধ থামানোর ভূমিকা নিয়েছে এমন নয়। তারা বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার বৈরি এই দেশ দুটিকে শান্তি আলোচনায় বসতে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের সেই ভূমিকা তেমন কার্যকর হয় নি। কারণ, যেমন ভারত, তেমন পাকিস্তান- তারা কেউই চায় নি তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বাইরের কেউ প্রভাব বিস্তার করুক। তারা এক্ষেত্রে একপক্ষ অন্যপক্ষের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। তবুও সর্বোপরি শান্তি ও যুদ্ধÑ  উভয় ক্ষেত্রেই ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে কেন্দ্রীয় অবস্থানে চলে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু সাম্প্রতিক সঙ্কট থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছে, তার অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে তারা। পূর্বেকার মতো ঘটে নি এবার। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সিনিয়র কর্মকর্তাকে ফুলেফেঁপে ওঠা সঙ্কট নিয়ন্ত্রণে পাঠানো হয় নি। সর্বোচ্চ যা ঘটেছে তা হলো, হামলার সময়ে দু’বার ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। তিনি ‘আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় ভারতের’ অধিকার আছে বলে সমর্থন প্রকাশ করেছেন। এমনকি এর মধ্য দিয়ে এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, এটা হলো ভারতের সামরিক হামলার একটি কৌশলগত অনুমোদন। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে হামলা চালাতে ভারতকে বিরত রাখতে যথেষ্ট উপায় অবলম্বন করে নি। এমন প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে দেখা যেতে পারে সঙ্কট থেকে সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে নিজেদের সরিয়ে নেয়া হিসেবে। খারাপ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র কম শক্তিসম্পন্ন একটি দেশ পাকিস্তানকে ভারতের বিমান হামলার প্রতিশোধমূলক জবাব দেয়া থেকে প্রতিরোধ করতে পারে না। দৃশ্যত, যুক্তরাষ্ট্র শুধু তখনই হস্তক্ষেপ করেছে যখন পাকিস্তান হামলার জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার পূর্ব পর্যন্ত তারা ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি অনুসরণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন নীতির সমর্থকরা বিষয়টিকে প্রধানত চারটি যুক্তির সঙ্গে দেখেন। অতি সাম্প্রতিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হলো অতিমাত্রায় বিস্তৃত ও অতিমাত্রায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র। এটা সত্য যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্র সারাবিশ্বে অতিমাত্রায় জড়িত বা সংশ্লিষ্ট। তিনি মনে করেন, বিশ্বের এসব প্রতিশ্রুতি থেকে তার সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু এই অবস্থান এমন অনুভূতি সৃষ্টি করে যে, এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণের রিসোর্স নষ্ট হচ্ছে। যাহোক, দক্ষিণ এশিয়া, প্রতিশ্রুতির সমস্যার চেয়ে নীতিগত দিক দিয়ে প্যারালাইসিস হয়ে আছে বলেই নিজেকে তুলে ধরে। ভারত বা পাকিস্তান কোথাও যুক্তরাষ্ট্র তার উল্লেখযোগ্য ‘ফিজিক্যাল’ উপস্থিতি প্রদর্শন করে নি। এক্ষেত্রে বড় যা করা হয়েছে তা হলো, গত বছরে পাকিস্তানকে দেয়া আর্থিক সহায়তার বড় কর্তন করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। তিনি ক্ষমতায় এসে যে ‘ক্র্যাক ডাউন’ করেছেন তাতে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরিবর্তে সমস্যা যেটা তা হলো, এ অঞ্চলটি ট্রাম্পের অগ্রাধিকার তালিকার নি¤েœ অবস্থান করছে। সর্বশেষ সঙ্কটের বিষয়টিই জোরালোভাবে তুলে ধরা যাক। এ সময়ে একজন নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত তো পরের কথা, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের একজন স্থায়ী রাষ্ট্রদূতই নেই, যিনি সঙ্কটকালে পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে রয়েছে ক্রমবর্ধমান অসংলগ্নতা। ইরানের অশোধিত তেল আমদানি করে ভারত। তাই ভারতের মতো দেশগুলো আর ‘ওয়েভার’ সুবিধা পাবে না বলে গত মাসে ঘোষণা করে ট্রাম্প প্রশাসন। একইভাবে, ২০১৭ সালের পর ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আর কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় নি। সহসাই হবার সম্ভাবনাও কম।
দ্বিতীয় ও অধিক বিশ্বাসযোগ্য যুক্তিটি হলো, চীনকে দমিয়ে রাখতে ভারতকে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। এক্ষেত্রে, ভারতের পক্ষ নেয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। যেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের রয়েছে জেনুইন ক্ষোভ। উভয় বিষয়ই সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে এবং কেন্দ্রাভিমুখি স্বার্থের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের কৌশলগত একটি আবেদন আছে। অভিন্ন এসব বিষয় চিন্তা করুন; অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূলবোধ, জ্বালানি নিরাপত্তা, ইসলামপন্থি উগ্রবাদীদের বিষয়ে উদ্বেগ, চীনের আগ্রাসী উত্থান, আফগানিস্তানের ভবিষ্যত ও ইন্দো-প্যাসিফিকে ভূরাজনৈতিক রূপরেখা প্রণয়ের বিষয়। দুই দেশের মধ্যেই এসব হচ্ছে কেন্দ্রাভিমুখী কৌশলগত ক্রমবর্ধমান স্বার্থ।
তবে পাকিস্তানের গুরুত্বকেও খাটো করে দেখা যাবে না। চীনকে কাউন্টার দিতে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন ভারতকে প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন পাকিস্তানকে পাশে রাখা। ভারত পূর্বমূখী নীতিতে জোর দিয়েছে, তবে তাদের প্রয়োজন একটি স্থিতিশীল পশ্চিমা ফ্রন্ট, যাতে পাকিস্তানের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য লিভারেজ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। একইভাবে পাকিস্তানের ওপর অতিমাত্রায় চাপ প্রয়োগ করার প্রকৃত অর্থ হতে পারে উল্টোমুখী। এতে পাকিস্তান আক্ষরিক অর্থেই চীনের বৃত্তে চলে যাবে। এমন একটি প্রেক্ষাপট যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত কারো কাছে কাঙ্খিত নয়।
তৃতীয় যুক্তিটি হলো, উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকে দেখা হয় পাকিস্তানের খারাপ আচরণের নিন্দা জানানো হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যে হস্তক্ষেপ করেছে তা হলো নয়া দিল্লির প্রতি তাদের সহানুভূতি। ইসলামাবাদকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সমর্থন বন্ধ করতে আহ্বান জানায় নয়া দিল্লি। তার অর্থ হলো প্রতিবারই দিল্লিকে সহানুভূতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে যা ঘটে তা হলো, পাকিস্তান বিরোধী ভারতীয় উদ্বেগকে বৈধতা দিয়ে আন্তর্জাতিকীকরণকে সহায়তা করা।
শেষ দফায়, দৃশ্যত মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে সুবিধাজনক অবস্থান হলো, ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে দিচ্ছে যে, পাকিস্তানের আগ্রাসনের জবাব সে কিভাবে নিতে চায় সে সিদ্ধান্ত তার, যেমনটা দেখা গেছে সাম্প্রতিক সঙ্কটের সময়। কিন্তু এক্ষেত্রে চিরস্থায়ী একটি সম্ভাব্যতা আছে। তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার ও অন্য রাষ্ট্রগুলোতে মধ্যস্থতার শূন্যস্থান পূরণে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের উদাসীনতা দ্বিধার সৃষ্টি করবে।
সম্প্রতি এ বিষয়টিই দৃশ্যমান হয়েছে, যখন উত্তেজনা প্রশমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে রাশিয়া ও চীন। উত্তেজনা কিছুটা কমে আসার পর এক সাক্ষাতকারে পাকিস্তানের একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, যদি আমি বলি অন্যদের মধ্যে রাশিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তাহলে তা মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না। একইভাবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই একইভাবে নিশ্চিত করেছেন যে, উত্তেজনা প্রশমনে গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে চীন। উপরন্তু, খুব সম্ভবত চীন থেকে আসা চাপের কারণে ভারতীয় আটক পাইলটকে ফেরত দিয়েছে পাকিস্তান।
পক্ষান্তরে, ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের থেকে অভিন্ন নয় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। এসব শক্তিধর দেশ ভারতের অবস্থানকে অনুমোদন দিয়েছে এবং তারা চুপচাপ বসে থাকার নীতি নিয়েছে। এমন প্রবণতায় বিশ্বজুড়ে শুভ প্রচেষ্টায় দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপরন্তু সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পক্ষকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মূলত দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যকার উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
এমন কি বাইরের গঠনমূলক প্রভাব থেকে কম সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাগুলো। তবু, দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়গুলোতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরত রাখা উচিত নয়। সবার আগে যা বলতে হয় তাহলো, এ অঞ্চলের বিষয়কে শুধু ইন্দো-পাক দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে দেখা বন্ধ করা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। এমন দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের সঙ্গে গুরুত্বকে খাটো করে দেখা হয়। এ দুটি দেশ এ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খুব সহায়ক। বিশেষ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। শ্রীলঙ্কায় সর্বশেষ যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে এবং তার দায় স্বীকার করেছে আইসিস সমর্থনপুষ্ট একটি গ্রুপ, সেই হামলা অধিক গুরত্বপূর্ণ একটি মাত্রা যোগ করেছে। আফগানিস্তানে আইসিসের উপস্থিতি মিলেয়ে দক্ষিণ এশিয়া দ্রুত আইসিস নেতৃত্বাধীন একটি জোটের নতুন ফ্রন্ট হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এসব হুমকি মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক এসব সক্রিয় অংশীদার প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের।
পাকিস্তান প্রসঙ্গে, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের ইস্যুতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শুধু মৌখিক হুমকি যথেষ্ট নয়। সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের সমর্থনের কারণে দেশটির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে শাস্তিমূলক সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনৈতিক সঙ্কট যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র অতি প্রয়োজনীয় আইএমএফের বেইলআউট থেকে রক্ষা করতে পাকিস্তানকে উচ্চ মাত্রায় প্রিমিয়াম দিতে পারে। একইভাবে, ফিনান্সিয়াল একশন টাস্ক ফোর্স এরই মধ্যে পাকিস্তানকে ‘গ্রে লিস্টে’ তালিকাভুক্ত করেছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অর্থায়নে বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য এমনটা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে যদি পাকিস্তান সন্ত্রাসকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যায় সেক্ষেত্রে পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত করার হুমকি দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে কাশ্মিরে ভারতের কঠোরতার বিষয়টিও চেক দিতে দেয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। গত বছর জাতিসংঘ প্রথমবার কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। তবে কাশ্মির ইস্যুতে বাইরের প্রেসক্রিপশন নিতে সব সময়ই বিরোধিতা করে এসেছে ভারত। এক্ষেত্রে কাশ্মির সমস্যাকে নমনীয়তার সঙ্গে মোকাবিলার জন্য ভারতকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
সাদা চোখে এটা মেনে নিতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে সরিয়ে নেয়ার যে ভূমিকা নিয়েছে তাতে অধিক থেকে অধিক হারে এখানে শিকড় গাঁড়বে চীন অথবা রাশিয়া। সম্প্রতি জাতিসংঘ মাসুদ আজহারকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে আগে যে বিরোধ ছিল, তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে চীন। ফলে ভারতের শুভকামনা অর্জন করেছে দেশটি। আর এর মধ্য দিয়ে ইন্দো-পাক গতিবিধিতে নিজেদেরকে সফলভাবে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে চীন ও রাশিয়া। সঙ্কটের সময়ে তারা প্রতীকী অর্থে পাকিস্তানের পাশে থেকেছে। একইভাবে এ অঞ্চলে পাকিস্তানের সঙ্গে শীতল যুদ্ধের সময় যে বিরোধ ছিল তা থেকে সাবধানে নিজেকে বের করে এনেছে ক্রেমলিন এবং দেশটির সঙ্গে তারা সম্পর্ক উন্নত করেছে। ভারতের সঙ্গে তাদের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, তাতে এর প্রভাব লাগতে দেয় নি রাশিয়া। বেইজিং এবং মস্কো দু’পক্ষই দক্ষিণ এশিয়ার বৈরিদের মধ্যে কখনো সমাপ্ত হবে না এমন এই সঙ্কট কিভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে সমতাভিত্তিক উদ্যোগ প্রদর্শন করেছে, যেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই শিখতে হবে।
এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে মেনে নিতে হলে এসব সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। যারা এটার পক্ষে যে, ওয়াশিংটন এমন ভূমিকা থেকে নিজের ভূমিকাকে খর্ব করলে তাতে শক্তির একটি কি ভয়াবহ শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তারা তা জানেন। এ অঞ্চলে রয়েছে আফগানিস্তানে শাস্তি প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের উচ্চাকাঙ্খা। এ অঞ্চলের এসব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। এই বিষয়টিকে অনুধাবন করে তাদেরকে আঞ্চলিক সম্পর্ক, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কে অনেক বেশি করে জড়াতে হবে। সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও এ অঞ্চল উভয়ের ভালোর জন্য।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এই উপমহাদেশ সফরে এসেছিলেন। তার সেই সফরের সময় তিনি যুদ্ধবিরতি রেখা (চিজফায়ার লাইন), যা ভারত ও পাকিস্তানকে বিভক্ত করেছে, সেই রেখাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপদজনক স্থান হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। বিষয়টি সেরকম সত্য আজও। যাহোক, ট্রাম্প প্রশাসনের সচেতনার অভাব আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে, যখন সাম্প্রতিক সঙ্কট আমাদেরকে এমন এক বিপদের মুখে ফেলে যায়, যেখানে এ অঞ্চলকে ফেলে রাখা হয় তার নিজস্ব বিবেচনার ওপর।
(মিনাম শাহ কাশ্মিরভিত্তিক আন্তর্জাতিক রাজনীতির ছাত্র এবং এশিয়ান পিস রিভিউ-এর সম্পাদক। অনলাইন ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ডট অর্গ-এ প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.