হাজার কোটি টাকার ফ্লাইওভার অন্ধকারে: বাতি লাগাতে ৩০ কোটি টাকার প্রকল্প by শুভ্র দেব

হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মালিবাগ-মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার। উদ্বোধনের দুই বছরও হয়নি। এর মধ্যেই পুরো ফ্লাইওভারটি রাতের বেলা আলোহীন। কোনো সড়ক বাতি না থাকায় অন্ধকারেই ঝুঁকি নিয়ে চলে যানবাহন। একই সঙ্গে ঝুঁকি বেড়েছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের। সম্প্রতি এ ফ্লাইওভারের উপর গলা কেটে এক মোটরবাইক চালককে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। উদ্বোধনের পর ফ্লাইওভারটি সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। এরপর থেকে ফ্লাইওভারের উপরে থাকা বাতি, তার চুরি হতে থাকে।
এখন পুরো ফ্লাইওভারের কোথাও বাতি জ্বলে না। এ অবস্থায় নতুন করে বাতি লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪৮ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করেছিল সিটি করপোরেশন। এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে শুধু বাতি লাগাতে এতো পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া যাবে না। এরপর নতুন করে সিটি করপোরেশন ৩০ কোটি টাকার আরেকটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে। নির্মাণ তদারকি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, কিছু বাতি চুরি ও নষ্ট অবস্থায় ফ্লাইওভারের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখন তাদের। আর সিটি করপোরেশন বলছে, দায়িত্ব গ্রহণের সময় কোনো বাতি ছিল না। তাই বাতি সংযোজন, রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার একটি বাজেট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে আপাতত বাতি লাগানোর কাজ করার জন্য। সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ পরে হবে। তাই ফের ৩০ কোটি টাকার একটি সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলেই বাতি লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হবে। মালিবাগ-মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল মানবজমিনকে বলেন, হস্তান্তরের সময় বেশিরভাগ বাতিই জ্বলতো। এটা ঠিক কিছু বাতি চুরি হয়ে গিয়েছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলে আবার লাগানো হয়েছিল। কিন্তু বারবার চুরির দায়ভারতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বহন করবে না। হস্তান্তরের আগে চার বার তার চুরি হয়েছে। তাই বলা হয়েছিল সিটি করপোরেশনই সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করুক। এখন দায়দায়িত্ব সবই সিটি করপোরেশনের। কারণ আমরা তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার দিন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় স্বাক্ষর করার সময় বাতি ছিল না। বাতি ছাড়াই আমরা বুঝে নিয়েছিলাম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাতি লাগিয়ে ছিল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাতি ও ইলেকট্রিকের তার চুরি হয়ে গেছে। গ্রহণের সময় মন্ত্রীকে এ বিষয়ে অবগত করেছিলাম। আমরা একটা বাজেটও মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সেটা আমরা করে দিব। এদিকে সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, প্রথমে ফ্লাইওভারে বাতি সংযোজন, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকার একটি বাজেট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেয়া হয়েছিলো। এর মধ্যে এলইডি বাতি ও আনুষঙ্গিক ফিটিংয়ের জন্য ২৭ কোটি ১৫ লাখ ১৭ হাজার, ফ্লাইওভারসহ নিচের রাস্তা, মিডিয়ান ও ফুটপাথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৪২ হাজার, ওয়াটার স্প্রিংকলিং ভেহিকলের জন্য ৩ কোটি ৬০ লাখ, একটি জিপ গাড়ি কেনার জন্য ৯০ লাখ, তিনটি মোটরসাইকেল ক্রয় বাবদ ৯ লাখ, দুটি হাইড্রলিক লেডারের জন্য ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ও ট্রাফিক সিগন্যাল, সাইন মার্ক, সিসি ক্যামেরা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই বাজেট জমা দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু মন্ত্রণালয় সেটি গ্রহণ করেনি। আপাতত বাতি লাগানোর কথা বলা হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। পরে সিটি করপোরেশন থেকে শুধুমাত্র এলইডি বাতি, ফিটিংস ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ৩০ কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট জমা দেয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সব কিছুই চুরি হয়ে গেছে। এখন নতুন করে আবার সবকিছু কিনতে হবে। সব মিলিয়ে বড় বাজেট লাগছে। বাজেট না আসলে কাজ শুরু করা যাবে না।
সরজমিন ফ্লাইওভারের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে, ল্যাম্পপোস্ট ছাড়া আর কিছুই নাই। কোথাও কোথাও ২/১ টি বাতি থাকলেও নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। চুরি হয়ে গেছে তার, বক্স। অন্ধকার ফ্লাইওভারে জমে উঠে অপরাধীদের আনাগোনা। রাত গভীর হলেই ছিনতাইকারী, মাদকসেবী, পেশাদার সন্ত্রাসীরা ফ্লাইওভারের ওপরে আড্ডা জমায়। সুযোগ পেলেই তারা মোটরসাইকেল আরোহীদের কাছ থেকে লুটে নেয় সবকিছু। আর গভীর রাতে পায়ে হাঁটা মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা অহরহ। এসব ঘটনার পর থেকে রাতের বেলা ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচলকারীরা আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। ২৬ শে আগস্ট পাঠাও চালক মিলনকে গলাকেটে হত্যা করে তার মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন নিয়ে গিয়েছিল পেশাদার ছিনতাইকারী নুর উদ্দিন।
মঙ্গলবার রাতে হলি ফ্যামেলি-সাতরাস্তা ফ্লাইওভারে প্রাইভেট কার চালক হেমায়েত উল্লাহ বলেন, আলো না থাকাতে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির আলো চোখে এসে পড়ে। এতে করে সামনের দিকে কিছু দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটনার সম্ভাবনা বেশি। ওয়ারলেস মোড় থেকে ইস্কাটন পর্যন্ত ফ্লাওভারে সিএনজি চালক আলম হোসেন বলেন, গাড়ির হেড লাইট নষ্ট থাকলে চলাচল করা কঠিন। কারণ ওপরে পুরোপুরি অন্ধকার। শুধুমাত্র হেডলাইটের ওপরে ভরসা করে চলতে হয়। একই ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেল চালক জুবায়ের হোসেন বলেন, মগবাজার চৌরাস্তার ওপরে প্রায়ই বখাটে ছেলেরা আড্ডা মারে। মাঝে মধ্যেই ছিনতাই হয়। শান্তিনগর-আবুল হোটেল ফ্লাইওভার অংশে আরেক মোটরসাইকেল আরোহী সীমান্ত আদিব বলেন, এই ফ্লাইওভারের ওপরে রাতের বেলা আমার এক বন্ধু ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিল । রাত আনুমানিক ১২টার দিকে সে রামপুরা থেকে কাকরাইলের বাসায় যাচ্ছিলো। আবুল হোটেল থেকে ফ্লাইওভারে উঠে ফরচুন মার্কেটের অংশে আসার পর তাকে দু’যুবক পথরোধ করে তার কাছে থাকা দুটি মোবাইল ফোন ও টাকা নিয়ে যায়। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম মানবজমিনকে বলেন, এত বড় একটা ফ্লাইওভার অথচ কোন বাতি নাই। রাতের বেলা অন্ধকার হয়ে থাকে। এভাবে অন্ধকারে থাকলে রাতের বেলা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে। যদিও বাতি লাগানোর বিষয়টা পুলিশের না। আমরা সিটি করপোরেশনকে বাতি লাগানোর কথা বলেছি। তাই খুব দ্রুত বাতি লাগাতে পারলে ভাল হবে। কারণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্লাইওভারের বিভিন্ন অংশে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। আলো না থাকাতে রাতের বেলা সিসি ক্যামেরা কাজ করে না।

No comments

Powered by Blogger.