এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার পর পর্যটকদের ফেরাতে হিমশিম খাচ্ছে শ্রীলংকা

গত বছরের অক্টোবরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ভ্রমণ কর্তৃপক্ষ লোনলি প্ল্যানেট ২০১৯ সালে ভ্রমণের জন্য আদর্শ যে জায়গাগুলোর তালিকা করেছিল, তাতে এক নম্বর অবস্থানে ছিল শ্রীলংকা। কিন্তু বিশ্ব সেই তালিকার কথা এখন ভুলে গেছে এবং এখন তাদের মাথায় আছে কেবল ইস্টার সানডের সন্ত্রাসী হামলার কথা, যে হামলায় ৩০০ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৪৭ জন হলো বিদেশী।
লোনলি প্ল্যানেটের মুখপাত্র ক্রিস জেইহার সে সময় বলেছিলেন, “২০১৯ সালে আমাদের হিসেবে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত দেশ হলো শ্রীলংকা। নিরক্ষীয় এলাকার দেশগুলোর মধ্যে চমৎকার পর্যায়ে রয়েছে দেশটি”। তার এই অনুমান করার কোন কারণই ছিল না যে, মাত্র ছয় মাস পর আইএস স্টাইলের সন্ত্রাসী হুমকির কারণে এই পর্যটনের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ তিরোহিত হবে। হোটেল এবং সৈকতগুলো খালি পড়ে আছে এবং সন্ত্রাসের আতঙ্ক মনে করিয়ে দিচ্ছে, এরপরও দ্বীপরাষ্ট্রটির পর্যটন শিল্প ছাইয়ের স্তুপ থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করছে।
২১ এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলায় যে বিপর্যয় ঘটে গেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল খুঁজছে এখন শ্রীলংকা সরকার ও দেশটির পর্যটন শিল্প। সন্ত্রাসী হামলায় পাঁচতারা হোটেল ও চার্চগুলোকে টার্গেট করা হয়েছিল।
শ্রীলংকার পর্যটকদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হলো চীন, যে দেশটি থেকে গত বছরে ২৬৫,৯৬৫ জন পর্যটক এসেছিল। ২১ এপ্রিলের হামলার পর প্রথম দেশ হিসেবে চীন তাদের ভ্রমণ নির্দেশনা শিথিল করেছে, যদিও সন্ত্রাসী হামলায় তাদের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী নিহত হয়েছে, যারা কলম্বোর কিংসবেরি হোটেলে সে সময় নাস্তা করছিল। যে পাঁচটি হোটেল সন্ত্রাসী হামলার কবলে পড়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ওই হোটেলটি ছিল অন্যতম। শ্রীলংকা এখন চীনকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নতুন করে পদক্ষেপ নিচ্ছে, কারণ এই দেশটির দেশের বাইরে যাওয়ার মতো পর্যটক রয়েছে ১৫০ মিলিয়নেরও বেশি।
স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল ও সেবাদাতাদের নিয়ে শ্রীলংকা ট্যুরিজম প্রমোশন ব্যুরো (এসএলটিপিবি) ২০১৯ সালের বেইজিং ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল এক্সপোতে (বিআইটিই) অংশ নিয়েছে। চীনের ন্যাশনাল কনভেনশান সেন্টারে বুধবার এই এক্সপো শুরু হয়ে ২০ জুন পর্যন্ত চলেছে। বৈশ্বিক পর্যটন সম্পদ ও পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিনিময় ও বাণিজ্য প্ল্যাটফর্ম এই বিআইটিই। এই এক্সপোতে বিভিন্ন ধরনের পর্যটন পণ্য, পর্যটন রিয়াল স্টেট এবং পর্যটন সুবিধার প্রদর্শনী ছিল। বিভিন্ন বিশেষ শহর ছাড়াও স্পোর্টস পর্যটন ও মেডিকেল পর্যটনের মতো বিশেষায়িত পর্যটনেরও প্রদর্শণী ছিল এক্সপোতে। এছাড়া সম্প্রতি ডাচ রাজধানী আমস্টারডামে সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিলাসবহুল পর্যটন নিয়ে যে প্রদর্শনী হয়েছে, সেখানেও সরব উপস্থিতি ছিল শ্রীলংকার। ইস্টার হামলার পর বহু ডাচ পর্যটক তাদের শ্রীলংকা সফর বাতিল করায় শ্রীলংকায় নেদারল্যান্ডস থেকে পর্যটক আগমণের হার ব্যাপক কমে যায়। ডাচ সরকার অবশ্য ৩১ মে তাদের ভ্রমণ সতর্কতা শিথিল করে, যেটা ২১ এপ্রিলের পর জারি করা হয়েছিল। সন্ত্রাসী হামলার সবচেয়ে বড় আঘাত পড়েছে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে, যেগুলো রয়েছে কলম্বোর ঠিক কেন্দ্রস্থলে। হোটেলগুলো হলো সিনামন গ্র্যান্ড, সাংগ্রি-লা এবং কিংসবেরি।
২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে শ্রীলংকার জিডিপির ৪.৯ শতাংশ এসেছিল পর্যটন খাত থেকে। ওই বছর ২.৩ মিলিয়ন পর্যটক শ্রীলংকা ভ্রমণ করেছিল, যারা সাথে এনেছিল ৪.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালের তুলনায় এই রাজস্বের পরিমাণ ছিল প্রায় ১২% বেশি।
উন্নত দেশগুলোর পর্যটকরা ভ্রমণে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। সেই দেশগুলো তাদের ভ্রমণ নির্দেশনা শিথিল করার পর শ্রীলংকা আবার আশাবাদী হয়ে উঠেছে যে, তাদের এই শিল্প আবার দ্রুত চাঙ্গা হয়ে উঠবে এবং এই শিল্পের জন্য ইস্টারের ঘটনার আগের মতোই চলতে থাকবে।
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পর্যটন শিল্পের বড় অংশই রয়েছে ক্ষুদ্র হোটেলগুলো এবং হাজার হাজার আবাসিক সুবিধাদাতাদের কাছে এবং পর্যটকদের আগমনের হার ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় এই ক্ষুদ্র পর্যটন ব্যবসায়ীদের উপর তার বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে, কারণ তারা মূলত তরুণ ব্যাকপ্যাকারদের উপর নির্ভর করে টিকে আছে। ক্ষুদ্র হোটেলগুলো একটা অনানুষ্ঠানিক খাত, যাদের জন্য সরকার ১.৫ বিলিয়ন রুপি জমা রেখেছে, যাতে তারা বিনা সুদে ৫ লাখ রুপি পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে। এই ক্ষুদ্র হোটেল মালিকরা মূলত নিজেদের বাড়িতে স্বল্প ব্যয়ের পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।
এসএলটিডিএ সূত্র মতে, ২০১৮ সালের মে মাসের তুলনায় এ বছরের মে মাসে পর্যটকের আগমনের হার ৭০% কম হয়েছে। তবে কিছু পর্যটন বিশ্লেষক উল্লেখ করেছেন যে, ইস্টার সন্ত্রাসী হামলা ব্যায়বহুল পর্যটকদের উপর যতটা প্রভাব ফেলেছেন স্বল্প ব্যয়ী ব্যাকপ্যাকারদের উপর ততটা প্রভাব ফেলেনি।
বিস্ফোরণের আগে, লোনলি প্ল্যানেট শ্রীলংকাকে এক নম্বর পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করায় সরকারের পরিকল্পনা ছিল ২০১৯ সালে পর্যটকের সংখ্যা ২.৫ মিলিয়নে নিয়ে যাওয়া, ২০১৮ সালে যে সংখ্যাটা ছিল ২.৩ মিলিয়ন। একই সাথে আয়ের পরিমাণ ৪.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা।
তবে, বর্তমানে পর্যটন খাতের আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বর্তমানে একটা বিতর্ক চলছে। অর্থমন্ত্রী মাঙ্গালা সামারাবিরা বলেছেন যে, এর পরিমাণ হবে ১.৫ বিলিয়ন ডলার কিন্তু ইকোনমিক রিফর্মস বিষয়ক মন্ত্রী ড. হার্শা ডি সিলভা বলেছেন যে, আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৫১ মিলিয়ন ডলার। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, ইস্টার সানডে হামলা শ্রীলংকার জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৪.৫% থেকে কমিয়ে ৩.৫ শতাংশে নিয়ে এসেছে।
এদিকে, পর্যটন বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, সন্ত্রাসী হামলার পর মুসলিম-বিরোধী যে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে, সেটা পর্যটন শিল্পকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। ইস্টার সানডে হামলার পর শ্রীলংকা সরকার যে জরুরি আইন জারি করেছিল, সেটাকে ৩০ জুনের পরে নিয়ে আর বর্ধিত করবে না সরকার। বিদেশী সরকারগুলো শ্রীলংকার পর্যটনের উপর যে ভ্রমণ সতর্কতা জারি রেখেছে, জরুরি অবস্থা তুলে নেয়ার পর তারা সেই সতর্কতা পুরোপুরি তুলে নিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.