এখনো হারিয়ে যায়নি নৌকাবাইচ by রাশিম মোল্লা

নদীতে পর্যাপ্ত পানির অভাব ও রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে বিলুপ্তির পথে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। আবহমান গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে রোয়িং ফেডারেশনের নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। কেবল মাত্র বুড়িগঙ্গা নদীতে বছরে একবার নৌকাবাইচ আয়োজন করেই তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। তবে গত বছর অনুষ্ঠিত হয়নি এই আসর। এবারকার আয়োজনেরও হদিস নেই। তবুও থেমে নেই বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য নৌকাবাইচ। গ্রামবাসীর উদ্যোগে এখনো হচ্ছে সুস্থ বিনোদনের এই উৎসব।
এক সময় বর্ষায় নৌকাবাইচ ছিল দেশের প্রধান উৎসব। প্রতি বছর বর্ষাকালে ভরা ভাদ্রে এ উৎসব পালিত হতো। এখন সেটা আর নেই। তবে একেবারে নেই সেটা বলা যাবে না। গতকাল মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইরে অনুষ্ঠিত হলো নৌকাবাইচ। উপজেলার বালিরটেকের কালিগঙ্গা নদীর দুইপারে লাখো মানুষের উপস্থিতি ছিল। গত বুধবার অনুষ্ঠিত নৌকাবাইচে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও ঢাকা-১ আসনের সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান বলেছেন, নৌকাবাইচ বাঙালির জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাজার বছরের গ্রামবাংলার সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ধারাবাহিকভাবে সুস্থ বিনোদন হিসেবে চলে আসছে। তাই এই নৌকাবাইচকে ধরে রাখতে হবে। হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। নৌকাবাইচ বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। তবে কবে এদেশে গণবিনোদন হিসেবে নৌকাবাইচের প্রচলন হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে দুটি জনশ্রুতি রয়েছে। একটি জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে। জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা প্রতিযোগিতার আনন্দ পায়। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচ শুরু। দ্বিতীয় জনশ্রুতি পীর গাজীকে কেন্দ্র করে। ১৮ শতকের শুরুর দিকে কোনো এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পারে দাঁড়িয়ে অন্য পারে থাকা তার ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখনই নৌকাটি মাঝ নদীতে এলো তখনই নদীতে তোলপাড় আরম্ভ হলো। নদী ফুলেফেঁপে উঠলো। তখন চারপাশে যত নৌকা ছিল তারা খবর পেয়ে ছুটে আসে। তখন সারি সারি নৌকা একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। এ থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহর আমলে নৌকাবাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। অনেকে মনে করেন, নবাব বাদশাহদের নৌবাহিনী থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চলের রাজ্য জয় ও রাজ্য রক্ষার অন্যতম কৌশল ছিল নৌশক্তি। বাংলার বারো ভূঁইয়ারাও নৌ-বলেই মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। মগ ও হার্মাদ জলদস্যুদের দমনে নৌশক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এসব রণবহর বা নৌবহরে দীর্ঘাকৃতির ছিপ জাতীয় নৌকা থাকতো। একেক অঞ্চলে একেক রকমের নৌকার প্রচলন রয়েছে। তবে নৌকাবাইচের জন্য যে নৌকা ব্যবহার করা হয় সেটা হয় সরু ও লম্বাটে। কারণ, সরু ও লম্বাটে হওয়ায় পানি কেটে দ্রুত চলতে সক্ষম এ নৌকা। নৌকার সামনের গলুইটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। কখনো করা হয় ময়ূরের মুখ, কখনো রাজহাঁস বা অন্য কোনো পাখির মুখাবয়ব। ঢাকা, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ অঞ্চলগুলোতে বাইচের জন্য সাধারণত কোশা নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর গঠন সরু এবং লম্বায় প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। কোশা নৌকার সামনের ও পেছনের অংশ একেবারে সোজা। বাইচের নৌকাগুলোর রয়েছে বিভিন্ন নাম। মাসুদ রানা, চার ভাই, দাদা-নাতী, পানির রাজ, শেখ বাড়ি, শিকদার বাড়ি, হাতনীর রাজ, বাংলার ঐতিহ্য, সোনার বাংলা, খান বাড়ি, জয় বাংলা, মধু মাঝি, নীল সবুজ, শাহজালাল, অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খিরাজ, ময়ূরপঙ্খি, সাইমুন, তুফানমেইল, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি। নৌকায় ওঠার ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক আনুষ্ঠানিকতা। সকলে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেঁধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। প্রতিটি নৌকায় ৫০ থেকে ১০০ জন মাঝি থাকে। যে কেউই নৌকার মাঝি হতে পারতো না। মাঝি হতে হলে তাকে একটু রুষ্টপুষ্ট হতে হতো। ছয় মাস আগে থেকেই বাছাই করা হতো মাঝিদের। সাধারণত ভাদ্র মাস আসার আগেই নদীপারের মানুষ প্রস্তুতি নেয় বাইচ উৎসবের। চলে নৌকার ঘষামাজা। সবার বাড়িতে চলে উৎসবের আয়োজন। বাড়ির বধূরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নৌকাবাইচ দেখতে আসা আত্মীয়দের জন্য পিঠাপুলি বানাতে। সকালে দলবেঁধে ছোটে নৌকাবাইচ দেখতে। বিকালবেলা শুরু হয় নৌকাবাইচের মূল আসর। ‘হেইয়ো রে হেইয়ো’ বলে মাঝিরা একসঙ্গে বৈঠা লাগায় নদীতে। জোড়ায় জোড়ায় শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সন্ধ্যায় চলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নির্ধারণী টান। তবে এখন আর আগের মতো দেখা যায় না নৌকাবাইচ। তবে স্বল্প পরিসরে এর আয়োজন এখন হলেও উৎসবের আনন্দ কিন্তু ভাটা পড়েনি। প্রতিবছরই আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচ। ইতিমধ্যে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জে স্থানীয়দের উদ্যোগে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী নৌকাবাইচ। এ ব্যাপারে নৌকাবাইচ ঐতিহ্য রক্ষা কমিটির সভাপতি মো. মাসুদ মোল্লা বলেন, এলাকার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কষ্ট হলেও প্রতিবছরই নৌকাবাইচের আয়োজন করছি। আবহমান গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে রোয়িং ফেডারেশনের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। তিনি বলেন, এক সময় নবাবগঞ্জে ইছামতি নদীতে প্রায় ৩০টি পয়েন্টে আয়োজন করা হতো নৌকাবাইচ। কিন্তু সরকারি সহায়তা না পেয়ে এখন অনেক স্থানেই বন্ধ হয়ে গেছে এ উৎসব। নবাবগঞ্জের শাহজালাল নৌকার মালিক ও নবাবগঞ্জ রোফিং ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব জামান বলেন, আমাদের এ এলাকায় পাঁচটি বাইচের নৌকা ছিল। এসব নৌকা উত্তাল পদ্মায় বাইচ দিতে যেত। ১৯৭৫ সালে আমাদের গ্রামের একটি নৌকা উত্তাল পদ্মায় বাইচ দিতে গিয়ে ডুবে যায়। তা আর পাওয়া যায়নি। তিনি আরো বলেন, এখন নৌকাবাইচে ফ্রিজ, মোটরসাইকেল ও টেলিভিশন পুরস্কার দেয়া হলেও আজ থেকে ৪০ বছর আগে পুরস্কার দেয়া হতো কলস ও শিল্ড।

No comments

Powered by Blogger.