ভুটানের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ by লুই জুড সেলভাদোরে

ভুটানের সরকার সম্প্রতি যে নীতি ঘোষণা করেছে তা বাস্তবায়িত হলে দেশটির শিক্ষক, চিকিৎসক ও অন্যান্য চিকিৎসা স্টাফ বেসামরিক কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি উপার্জন করবেন। নতুন বেতন স্কেল প্রায় ১৩ হাজার শিক্ষক ও চিকিৎসকের জন্য কল্যাণকর হবে। এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। অন্য কোনো দেশ সম্মানি ও প্রতীকীভাবে তাদের সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে চিকিৎসক ও শিক্ষকদের এমন গর্বের স্থানে রাখেনি। উল্লেখ্য, প্রস্তাবটির উত্থাপনকারী ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং নিজে একজন পাস করা চিকিৎসক। ফলে পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকেই এই নীতির প্রস্তাব করা হয়েছে, বলা যায়।
উদ্দীপনা না উদ্ভট?
আসুন আমরা নীতিটির শিক্ষাগত দৃশ্যপট থেকে পরীক্ষা করি যে প্রস্তাবটি একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশবিশেষ নাকি উদ্দীপ্ত এই প্রস্তাবটির আসলে কার্যকারিতা তেমন থাকবে না?
প্রস্তাবটির রেশ পাওয়া যাবে ভুটানের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস কমিশনের দ্বাদশ পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১৮-২৩)। ‘শিক্ষাকে একটি পছন্দ করে নেয়ার বিষয়’ হিসেবে মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দেশটির মানব উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষকের ঘাটতি থেকে, বিশেষ করে সর্বোত্তম শিক্ষক না পাওয়ার কারণ থেকে। স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, ভয়াবহ রক্তক্ষরণ বন্ধ করার প্রতিষেধক হিসেবে ভুটান সরকার এ নীতি গ্রহণ করতে চাচ্ছে।
সহজাতভাবেই বোঝা যাচ্ছে, ভুটান সরকার একটি পেশায় সেরা প্রতিভাদের আকৃষ্ট করতে যাচ্ছে। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিক্ষক পেশার মর্যাদা বৃদ্ধি কি শিক্ষার ফলাফলকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারবে?
অর্গ্যানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট (পিআইএসএ) একটি বিশ্বব্যাপী সমীক্ষা যা পঠন, গণিত, বিজ্ঞান ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ছাত্রদের সক্ষমতা তুলনা করে। এর আলোকে সংস্থাটি দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার র‌্যাংক করে থাকে। অর্থনীতিবিদ পিটার ডোলটনের পরিচালিত একটি স্বাধীন সমীক্ষায় দেখা গেছে, পিআইএসএর নম্বর অনুযায়ী, ছাত্রদের ফলাফলের সাথে শিক্ষকদের মর্যাদার একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। গ্লোবাল টিচার স্টাটাস ইনডেক্স ২০১৮-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে ৩৫টি দেশের সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধির সাথে উচ্চ বেতনের সম্পর্ক রয়েছে।
সরকার যে ক্ষেত্রে সাফল্য চায়, সেখানে নজর দিয়ে নীতি প্রণয়ন সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। ভুটানের নীতিটি বাস্তবায়িত হলে তাতে কী ফলাফল হয়, তা জানার জন্য কয়েক বছর সময় লাগবে। তবে এ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা হতে হবে।
রাজস্ব সংশ্লিষ্টতা
ভুটান এখন তার জিডিপির ৭.৫ ভাগ ব্যয় করছে শিক্ষা খাতে। নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে তার প্রভাব কতটা হবে তা এখনো অস্পষ্ট। সাধারণভাবে শিক্ষকেরা সরকারি কর্মীতে একটি বড় অংশজুড়ে থাকে। ফলে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর আগে আর্থিকভাবে তা কতটা যৌক্তিক হবে, তা ভেবে দেখতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষা খাতে ভারতের তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকা তামিল নাড়ুতে পেনশন বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘটরত শিক্ষকদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ভারতীয় রাজ্যটির শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, রাজ্যের মোট ব্যয়ের ৭১ ভাগ ব্যয় হয় বেতন, পেনশন, প্রশাসনিক ব্যয় ও সুদ পরিশোধে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বাকি থাকে অতি সামান্যই।
ভারত কি একই ধরনের নীতি বাস্তবায়ন করতে পারবে?
ভারত বর্তমানে শিক্ষা খাতে জিডিপির প্রায় ৩ ভাগ ব্যয় করে থাকে। এটি কেন্দ্র ও রাজ্যের বাজেটের ব্যয়ের ১০ ভাগ। এই ব্যয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় বেতনে। গত বছরের নীতি আয়োগের এক প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, ভারত ২০২২ সাল নাগাদ জিডিপির ৬ ভাগে উন্নীত করা হবে। শিক্ষক ও চিকিৎসকদের বেতন ব্যাপকভাবে বাড়ানো হবে কঠিন কাজ। তবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো শিক্ষকদের নিয়োগ ও বিদ্যমান কর্মসূচিগুলোতে তহবিল বরাদ্দ যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। আর এই ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার সৃষ্টি করা হলে বিপুল সাশ্রয় হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে ভারতে অনুপস্থিতি প্রায় ২৪ ভাগ। এর ফলে দেশে প্রতি বছর ব্যয় হয় ১.৫ বিলিয়ন ডলার। অনুপস্থিতির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আয় বাড়ানোর শিক্ষকদের আরেকটি চাকরি গ্রহণ বা কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকা, গৃহকর্মী বা সাহায্যকারী রাখতে না পারায় শিশুর পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত থাকা। কিংবা অনেকে যথার্থ উৎসাহ না পেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষা প্রদান করতে পারেন না। বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা হলে অনেক অপচয় বা দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, জাতীয় লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে।
দিল্লি বা ছোট ছোট রাজ্যে এ ধরনের কার্যক্রম পাইলট প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। দিল্লি সরকারের অন্যতম গুরুত্ব দেয়া ক্ষেত্র হলো শিক্ষা। দিল্লির রাজ্য সরকার তাদের বার্ষিক বাজেটের ২৬ ভাগ ব্যয় করে এই খঅতে। এটি জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। এই রাজ্যে শিক্ষা প্রশাসনও উন্নত করার প্রয়াস চলছে। রাজ্যটি মোটামুটিভাবে নগরকেন্দ্রিক হওয়ায় এখানে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অনেক সহজ হয়।
পরিশেষে বলা যায়, একটি শিক্ষিত, স্বাস্থ্যকর, দায়িত্বশীল ও সুখী সমাজ সৃষ্টি করে এমন কোনো বিনিয়োগই কোনো সমাজেই খুব বেশি বিবেচিত হতে পারে না। ওইসিডির প্রতিবেদনে যথার্থ ভাবেই বলা হয়েছে, মানসম্পন্ন শিক্ষা হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচক। শিক্ষা খাতে অর্জনে ঘাটতির মূল্য হতে পারে চরম। সরকারকে এই ক্ষতি পূরণের উপায় বের এবং সবার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করতেই হবে। সরকার যদি মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চায়, তবে তাকে নীতিপ্রণয়ন পর্যায়ে অবশ্যই বেতন বৃদ্ধির কাজটি করতেই হবে। সবচেয়ে মেধাবীদের এই খাতে আকৃষ্ট করার জন্য তাদেরকে সবচেয়ে বেশি বেতন দিয়ে তাদের মর্যাদা বাড়াতেই হবে। আর ভুটান বিপ্লবী নীতি গ্রহণ করে এই দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
>>>লেখক: কমিউনিকেশন্স কনসাল্টেন্ট, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ

No comments

Powered by Blogger.