মালয়েশিয়ায় চারকন্যার পাঁচ দিন by সানজিদা আফরোজ

চাকরি, সন্তান, সংসার নিয়ে দুনিয়ার ব্যস্ততা! সবকিছু সামলে সময় বের করতে হিমশিম খেতে হয়। তখন কীভাবে যেন মাথায় এলো কোথাও ঘুরতে গেলে মন্দ হয় না! ঠিক করলাম, শুধু বন্ধুরা মিলে কোথাও বেড়াতে যাবো। কিন্তু কোথায়? তখন ইচ্ছের পালে হাওয়া দিলো নাজিয়া। মালয়েশিয়া প্রবাসী এই বন্ধু বললো, ‘চলে আয় আমার এখানে। বাকিটা আমি দেখছি।’
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে আমাদের সাতজনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। সাভার ক্যাম্পাসে একটি সেমিস্টার করতে গিয়ে তা আরও সুদৃঢ় হয়। খাওয়া, ক্লাস, ল্যাব, চাঁদ দেখা, আড্ডা, পড়ালেখাসহ সব একসঙ্গে হতো তখন। আমাদের এই বন্ধু দলটির নাম ‘বাকাম’। সাতজনের মধ্যে চারজন এখন দেশের বাইরে থাকে। শান্তা, ঊর্মি আর আমি থাকি বাংলাদেশে।
নাজিয়ার উৎসাহ পেয়ে আমরা তিন বন্ধু ঠিক করলাম মালয়েশিয়াই যাবো। জীবনে প্রথম পরিবারকে ছেড়ে দূরে যাচ্ছি। আমার মা সহজে রাজি হননি। আমার স্বামী ও বোন মিলে বোঝানোর পর তার অনুমতি পাওয়া গেলো। মায়ের কাছে রেখে গেলাম বাচ্চাকে। স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির সমর্থন থাকায় বিমানের টিকিট কেটে আমরা সাহস করে পা বাড়ালাম।
বন্ধুদের নিয়ে বেড়ানো অন্যরকম আনন্দের। দেশের বাইরে গিয়ে বুঝলাম, আমরা বন্ধুরা একজন আরেকজনের কতটা আপন। আগেও বন্ধুরা মিলে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম। ওই ভ্রমণ ছিল বিয়ের আগে। এবার আমরা ই-ভিসা নিয়ে যাই। বিমানে উঠে পড়লাম আমি, শান্তা আর ঊর্মি। আকাশে ওঠার পর মনে পড়ছিল কবিগুরুর গানের লাইন, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।’
নাজিয়া ও তার স্বামী আরিফ দু’জনই আমাদের বন্ধু। এবার কোথায় কোথায় ঘুরবো তা আগেই নাজিয়াকে বলে রেখেছিলাম। যেহেতু সারাদিন টো-টো করে কাটবে, তাই রান্নার ঝামেলা যেন না থাকে তাও বলে দিয়েছিলাম।
মালয়েশিয়া ভ্রমণে এর আগে ল্যাংকাউই দেখেছি। এবার কুয়ালালামপুর সিটিতে যতটা পারা যায় বেড়ানোর পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। দেশ থেকে আমরা তিনজন আর সঙ্গে প্রবাসী নাজিয়া ও আরিফ দম্পতি, সবাই মিলে দারুণ সময় কেটেছে।
আমরা সকালে বাসার পাশের হোটেল থেকে নাশতা খেয়ে বের হতাম। এরপর সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি ও ছবি তোলা চলতো। একদিন রাতে মালয়েশিয়ান মেন্যু দিয়ে ডিনার করেছিলাম। খুব সুস্বাদু ছিল। এছাড়া ম্যাকডোনাল্ড সাবওয়ে ও বার্গার কিংয়ে বেশি খাওয়া হয়েছে আমাদের।
ভ্রমণের প্রথম দিন বিমানবন্দর থেকে বাসায় পৌঁছে নাশতা খেয়েই বেরিয়ে পড়ি পুত্রজায়ার উদ্দেশে। সেখানেই দুপুরের খাবার সেরে চলে যাই আসতাকা মরক্কোতে। জায়গাটা খুব নিরিবিলি। সেখানকার লেক খুব সুন্দর। মন চেয়েছিল, লেকের সামনে চুপচাপ বসে থাকি অনেকক্ষণ।
কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টারে ঘোরাঘুরি ও ছবি তোলার পর আড্ডায় সময় কেটে যায়। রাতে ঢুকে পড়েছি সিনেমা হলে। আমরা একটু দেরি করে ফেলেছিলাম। নির্দিষ্ট আসন খুঁজে বসে পড়লাম। ঠাণ্ডা বেশি লাগলে কম্বল মুড়ি দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল প্রেক্ষাগৃহে। সবাই শুয়ে-বসে ছবি দেখছে। সব মিলিয়ে এলাহী কাণ্ড!
বলিউড সুপারস্টার সালমান খানকে হা হয়ে দেখছিলাম। এক লোক আমার পাশে এসে বললেন, ‘ম্যাডাম অর্ডার প্লিজ।’ শুনে হতবাক হলাম। মেন্যুতে সব রাতের খাবার। আমরা অর্ডার দিলাম। খেতে খেতে সিনেমা দেখা হলো।
পরদিন আমাদের গন্তব্য ‘জালান আলোর’ নামের একটি জায়গা। সেখানকার কয়েকটি ভবনে খুব সুন্দরভাবে রঙ করা। সেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা। আমরাও ছবি তুললাম।
ঘোরাফেরা করে গাড়িতে চড়ে বসলাম। আরিফ ড্রাইভ করছে। গান-আড্ডা চলছে। বিকালে চলে এলাম মালাক্কা স্ট্রেইটস মসজিদে। সাগরের ওপর অবস্থিত এটি। সেখানে অদ্ভুত সুন্দর হাওয়ায় মন জুড়িয়ে গেলো।
সেদিন সূর্যাস্ত দেখতে মেলাকায় দ্য শোর স্কাইটাওয়ারে উঠলাম। জনপ্রতি খরচ ৩৫ রিঙ্গিত। ৪৩ তলার ওপর থেকে পুরো মেলাকা শহর দেখা যায়। খুব সুন্দর একটা জায়গা। পুরো শহর তখন আলো ঝলমলে। অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে রাতের শহর দেখতে অন্যরকম লেগেছে। সেখান থেকে বাসায় ফেরা তিন ঘণ্টার যাত্রা। গান শোনা ও বন্ধুদের আড্ডায় কেটে গেলো পথ।
একরাতে নাজিয়াসহ আমরা চার বান্ধবী পাঁচতারকা হোটেল লেক্সিস হিবিসকাস পোর্ট ডিকসন প্রিমিয়াম পুল ভিলায় ছিলাম। বন্ধুরা মিলে অনেক সুন্দর সময় কাটলো। হোটেলের সার্ভিসও ভালো। আড্ডার ফাঁকে ভোর ৪টায় অর্ডার দিয়েও খাবার পেয়েছি।
এবার মালয়েশিয়া গিয়ে জেন্টিং হাইল্যান্ডস ক্যাবল কারে চড়েছি। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। যাতায়াতের পথ সুন্দর। আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি। শুধু আফসোস, চাঁদের দেখা পাইনি।
আমরা কেউই তেমন কেনাকাটা করিনি। বেশি ইচ্ছে ছিল ঘুরে বেড়ানো। যা কিছু কিনেছি বেশিরভাগই বাচ্চাদের জন্য। পাঁচদিন কীভাবে কেটে গেলো টেরই পাইনি!
>>>ছবি: লেখক

No comments

Powered by Blogger.