ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে আমেরিকার প্রচেষ্টা

তেহরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের বিতর্ক ২০০০ সালের প্রথম থেকে চলে আসছে। এ বিতর্কের জের ধরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বিশ্ব একতরফাভাবে কিংবা নিরাপত্তা পরিষদকে ব্যবহার করে ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। সবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরব।

পরমাণু সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা এবং এ ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছতে ইরানের আন্তরিকতার কারণে শেষ পর্যন্ত ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের পরমাণু সমঝোতা সই হয়। ২০১৫ সালের জুনে এ চুক্তি সই হয় এবং ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে এটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়। ইরানের পরমাণু কার্যক্রম দেখাশোনাকারী আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ'র প্রতিটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইরান তার প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি মেনে চলেছে। কিন্তু দেখা গেছে ইরান পরমাণু সমঝোতা পুরোপুরি মেনে চললেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকে নানা অজুহাতে তারা পরমাণু সমঝোতা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থেকেছে। এরপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরই পরমাণু সমঝোতা থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেন। ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারের সময় এবং ক্ষমতায় আসার পরও পরমাণু সমঝোতাকে সবচেয়ে খারাপ চুক্তি বলে অভিহিত করেন। তিনি ২০১৭ সালের মার্চে পরমাণু সমঝোতার ব্যাপারে বলেন, এটি আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে খারাপ চুক্তি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদিও ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর কয়েক দফা পরমাণু সমঝোতার প্রতি তার সমর্থনের মেয়াদ নবায়ন করেছেন কিন্তু এরপর তিনি আর নবায়ন করেননি। অনেক দ্বন্দ্ব-সন্দেহ ও বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালের ৮মে পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে দুই দফায় তিনি ফের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি সইয়ের প্রস্তাব দেন। এবার তিনি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে সীমিত করণ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব খর্ব করার বিষয়টি নতুন চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেন। তার ওই প্রস্তাবের প্রতি সৌদি আরব ও দখলদার ইসরাইলের সমর্থন রয়েছে।

আমেরিকা ভাল করেই জানে ইরান পরমাণু সমঝোতার সকল প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে। তারপরও তারা ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ এ পর্যন্ত ১৫টি প্রতিবেদনে বলেছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে বিচ্যুতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

যেকোনো অজুহাতে পরমাণু সমঝোতা থেকে আমেরিকার বেরিয়ে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে দখলদার ইসরাইলের ইচ্ছা অনুযায়ী ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও গত বছর মে মাসে ইরানকে ১২টি প্রস্তাব দেন। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, পরমাণু সমঝোতা ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে এবং পশ্চিম এশিয়ার ব্যাপারে ইরান কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে আমেরিকা চলতি বছর মে মাসে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত দেশগুলোকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেয়। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণায় গত ৩মে এক বিবৃতিতে জানায় ৪মে থেকে ইরানের বুশেহর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়াম ও ভারি পানি ইরানের বাইরে স্থানান্তরের সঙ্গে জড়িত দেশগুলোকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে। বিবৃতিতে আরো বলা হয় ওয়াশিংটন ইরানকে ভারি পানি মজুদ করারও সুযোগ দেবে না। 

পরমাণু সমঝোতায় ইরানকে ৩.৬৭ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমেরিকা ইরানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চায়। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, "ট্রাম্প প্রশাসন এখনো ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকি বলে মনে করে। তাই ইরান যাতে কোনো ভাবেই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হতে না পারে সেজন্যই দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।"

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ ধরণের বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে আমেরিকা আসলে ইরান থেকে ওমানে ভারি পানি স্থানান্তরে বাধা দেয়া এবং বুশেহর পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রে রাশিয়ার সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দাবি করেছেন, "ইরান যাতে কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হতে না পারে সেজন্যই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।" মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এমন সময় এ মন্তব্য করেছেন, যখন আইএইএ'র ১৫টি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে "ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ।"

তাই বলা যায়, আমেরিকার এ পদক্ষেপ পরমাণু সমঝোতা এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ২২৩১ নম্বর প্রস্তাবের লঙ্ঘন। আমেরিকা কেবল গায়ের জোরে ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করার জন্য অন্য দেশকে বাধ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও'র দেয়া ১২টি প্রস্তাব ইরান প্রত্যাখ্যান করায় এখন আমেরিকা নিজেই ইরানকে তা মেনে নিতে বাধ্য করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি ওয়াশিংটন ইরানের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে আইএইএ'র প্রতিবেদনকেও অগ্রাহ্য করছে এবং তেহরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টির নীতি গ্রহণ করেছে।

আমেরিকার তৎপরতা শুধু পরমাণু সমঝোতার বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ নেই। তারা ইরানের কাছে আরো কিছু চায়। এ অবস্থায় আমেরিকা পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরোপ তাদের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ইরান পরমাণু চুক্তির বেশ কিছু ধারা বাস্তবায়ন স্থগিত রেখেছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ'র মুখপাত্র গত ১ জুলাই জানিয়েছেন, ইরান সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের মজুদ ৩০০ কেজি ছাড়িয়েছে। এর জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, "ইরানের জন্য আমাদের আর কোনো বার্তা নেই এবং দেশটি আগুন নিয়ে খেলছে।"

হোয়াইট হাউজ এক বিবৃতিতে বলেছে, "নতুন করে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের তৎপরতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং এর জন্য দেশটির ওপর সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, সর্বনিম্ন মাত্রায়ও ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অনুমতি দেয়া উচিত হয়নি যা ছিল পরমাণু সমঝোতার একটি ভুল দিক। এমনকি পরমাণু সমঝোতার আগে থেকেই ইরান তা লঙ্ঘন করা শুরু করে। আমরা চাই ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনতে। আমেরিকা ও তার মিত্ররা ইরানকে পরমাণু বোমা তৈরির কোনো সুযোগ দেবে না।"

পর্যবেক্ষকরা বলছেন এ বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে আমেরিকার আসল চেহারা ও উদ্দেশ্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। কারণ এটা সবারই জানা আছে ইরান কখনই পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না। প্রকৃতপক্ষে, দখলদার ইসরাইলের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও চান ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনতে যাতে দেশটি চিকিৎসা কিংবা জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নয়নে সফল হতে না পারে।

No comments

Powered by Blogger.