অমিত শাহের ‘গোর্খাল্যান্ড’ উল্লেখে বিচলিত পশ্চিমবঙ্গের দলগুলো by সুবীর ভৌমিক

কাশ্মীরের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলুপ্ত করা ও রাজ্যটিকে দুটি ইউনিয়নভুক্ত ভূখণ্ড হিসেবে খণ্ডিত করার পর থেকে মোদি-শাহ জুটির পরবর্তী রাজনৈতিক টার্গেট নিয়ে ব্যাপক রাজনৈতিক গুঞ্জন চলছে। বেশির ভাগই মনে করছে যে পশ্চিমবঙ্গই হতে পারে পরবর্তী টার্গেট। কারণ তিক্ত নির্বাচনী প্রচারকাজের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার গদাধারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রায়ই পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলাকে ‘কাশ্মীরের চেয়েও খারাপ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
মোদি-শাহ ও পশ্চিমবঙ্গের রণংদেহী নারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মধ্যে কথার যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দার্জিলিংয়ের এমপি রাজু বিস্তার কাছে লেখা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের একটি চিঠিতে ‘গোর্খাল্যান্ড’ শব্দটি থাকায় জল্পনা শুরু হয়েছে যে নেপালি-সংখ্যাগরিষ্ঠতাপূর্ণ চা উৎপাদনশীল অঞ্চল দার্জিলিংকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেটে আলাদা করা হবে। আলাদা গোর্খাল্যান্ডের দাবি সেই ১৯৮০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে। ওই সময় দার্জিলিং আলাদা রাজ্যের জন্য সহিংস বিক্ষোভ করেছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার তখন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন বামদের একটা শিক্ষা দেয়ার জন্য আন্দোলটিকে উৎসাহিত করেছিল। পরে তারা কেন্দ্র, রাজ্য সরকার ও গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (জিএনএলএফ) মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করার ব্যবস্থা করে। চুক্তিটি দার্জিলিংয়ের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্বশাসনের ব্যবস্থা করলেও গোর্খাদের অন্যান্য দল প্রায়ই আলাদা রাজ্যের দাবি তুলে থাকে। তারা জিএনএলএফের বিরুদ্ধে স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়ার অভিযোগ এনে থাকে। পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় বিজেপি তার প্রার্থীদেরকে গোর্খাল্যান্ডের দাবির প্রতি সমর্থন দেয়ার ইঙ্গিত দিয়ে এই আগুনে ইন্ধন দিয়েছে। এর ফলে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে লোকসভার নির্বাচনে দার্জিলিঙের আসনে বিজেপির প্রার্থী জয়ী হয়। বিজেপি মমতার ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসকে গোর্খা আকাঙ্ক্ষার প্রতি উদাসিন বাঙালি দল হিসেবে চিত্রিত করে।
চলতি সপ্তাহে দিল্লি পুলিশ বিশেষ বাহিনী গোর্খাদের নিয়োগ করছে না মর্মে অভিযোগ-সংবলিত বিজেপির দার্জিলিং এমপি রাজা বিস্তার চিঠির জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ‘গোর্খাল্যান্ড’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এটি বিস্তা ও তার সমর্থকদের বিস্মিত করে। কারণ গোর্খাল্যান্ডের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে অমিত শাহের জবাবটি সামাজিক মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। তৃণমূল কংগ্রেস, বাম দলগুলো ও কংগ্রেসের রাজনীতিবিদেরা দার্জিলিঙে নতুন করে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করার জন্য অমিত শাহকে আক্রমণ করেন। তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক পার্থ চ্যাটার্জি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে গোর্খাল্যান্ড ভূত জাগিয়ে তোলার জন্য অমিত শাহকে দায়ী করেন। লাদাখকে আলাদা ইউনিয়ন অঞ্চল ঘোষণা করার পর গোর্খা জনমুক্তি মঞ্চের (বিমল গুরুঙের নেতৃত্বাধীন) মতো দার্জিলিংভিত্তিক কয়েকটি দল আবারো গোর্খাল্যান্ডের দাবি তুলেছে। পার্থ চ্যাটার্জি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্রেফ পশ্চিমবঙ্গে বিজয়ী হওয়ার জন্য আবারো সহিংসতা ও গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করবেন। তবে তিনি সফল হবেন না। কংগ্রেস ও বাম নেতারাও একইরকম সমালোচক। স্বায়ত্বশাসনপন্থী গোর্খা নেতা ব্লনয় তামাঙের মতো নেতারা এসএএমকে বলেন, অমিত শাহের গোর্খাল্যান্ডের উল্লেখ্য গোর্খা ভোট পাওয়ার কৌশল মাত্র। এতে সম্প্রদায়ের কোনো লাভ নেই।
বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতারা অমিত শাহের পদক্ষেপে উদ্বিগ্ন। দুর্গাপুরে চিন্তন (কৌশলগত) সভায় বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ নেতারা বসেছিলেন রাজ্যে তাদের করণীয় নির্ধারণ করতে। এতে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলিপ ঘোষ বা রাজ্য নির্বাহী পরিষদের অন্যান্য সদস্য দার্জিলিং, গোর্খাল্যান্ড বা অমিত শাহের চিঠির কোনো ধরনের উল্লেখ এড়িয়ে যান। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বিজেপির এক সিনিয়র সদস্য বলেন, অমিত শাহ যদি গোর্খাল্যান্ড সমর্থন করে, তবে আমরা পশ্চিমবঙ্গে শেষ হয়ে যাব। মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের আবার দ্বিখণ্ডিত করা নিয়ে বাঙালি ভাবাবেগ জাগিয়ে তুলবেন, ঠিক যেমন করেছিলেন জ্যোতি বসু ১৯৮০-এর দশকে। আন্দোলনটি বেগবান হওয়ার সময় কেন্দ্রকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করে কংগ্রেসকে স্রেফ শেষ করে দিয়েছিলেন। মমতাও একই কাজ করবেন।
ওই নেতা বলেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপি অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো করেছে বাংলায়। তারা ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসন পেয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সদস্য সংগ্রহের যে টার্গেট নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, তার চেয়ে অনেক কম হয়েছে, বিশেষ করে কলকাতার মতো বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়। বিজেপির ওই নেতা বলেন, গোর্খা, রাজবংশী ও ঝারখন্ডি উপজাতীয় লোকজনের অধ্যুষিত, হিন্দু ভাষাভাষী শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের এলাকাগুলোতে দলটি ভালো করেছে। কিন্তু বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ভালো করেনি। বাঙলার সাত ধাপের নির্বাচনের শেষ পর্বে দলটি কলকাতার ৯টি আসনের সবগুলোতেই পরাজিত হয়। এর আগ দিয়ে ঊনিশ শতকের বাঙালি সমাজ সংস্কারক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙ্গে দিয়েছিল গেরুয়া সমর্থকেরা।
বিজেপি নেতা বলেন, কলকাতার অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সদস্যপদ লাভের উদ্যোগে ভালো সাড়া পাওয়া গেলেও যাদবপুর, গড়িয়া, দমদম ও টালিগঞ্জের মতো বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় টার্গেট পূরণ অনেক কম হয়েছে। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গ শাখা সভাপতি দিলিপ ঘোষ এখন সদস্য সংগ্রহের জন্য বাড়ি বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সদস্যপদ পূরণের টার্গেট ভয়াবহ রকমের ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই তিনি এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে চাচ্ছেন।
তিনি বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে যদি ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে দিল্লিতে আমাদের সরকার গোর্খাল্যান্ডের দাবি সমর্থন করছে, তবে আমরা বাকি বাংলায় খেলায় হেরে যাব। বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে এবং তারা ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। মমতার অপঃশাসন আমাদের একটি সুযোগ দিয়েছিল, কিন্তু যেকোনো ভুল পদক্ষেপ হবে আত্মঘাতী। তিনি উদ্বিগ্ন যে মমতা ইতোমধ্যেই বাঙালি কার্ড খেলা শুরু করে দিয়েছেন বেশ ভালোভাবেই ও বেশ কার্যকরভাবেই। তিনি বলেন, বাঙলা থেকে কাশ্মীর ভিন্ন। লাদাখ আর জম্মুতে আছে তিন এমপি, কাশ্মীরে আছে একইসংখ্যক। আর দার্জিলিঙে আছে মাত্র একটি এমপি আসন। বাকি বাঙলায় আছে ৪১টি।
দার্জিলিং চা শিল্প (যদিও এর নিলাম নিয়ন্ত্রিত হয় কলকাতায়) থেকে পশ্চিমবঙ্গ কিছু রাজস্ব হারাবে, কিন্তু মাংস প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া, হাইটেক ও পর্যটন খাতে নতুন নতুন শিল্প থেকে অনেক বেশি আয় করতে পারবে। বর্তমান ফিন্যান্সিয়াল কোয়ার্টারে ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ জিএসডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, ১২.৫৮ ভাগ, যা জাতীয় জিডিপির ৫.৮ ভাগের চেয়ে অনেক বেশি। আর কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থার তথ্যে দেখা যায়, কেবল জিএসডিপি প্রবৃদ্ধিতে নয়, শিল্প খাত ও জিএসটি সংগ্রহের দিক থেকেও পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে আছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি চুইয়ে পড়া থেকে রাজ্যটি লাভবান হচ্ছে।
তবে তৃণমূলের ভেতরের লোকজন আশঙ্কা করছে, পশ্চিমবঙ্গকে খণ্ডিত করে অমিত শাহ অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে দীর্ঘ সময় নির্বাচন না করার অজুহাত সৃষ্টি করতে গোর্খাল্যান্ড সৃষ্টি করে সেটিকে রাষ্ট্রপতির শাসনে নিয়ে আসতে পারেন। তৃণমূলের মুখপাত্র ও বাঙলা পক্ষ নেতা গর্গা চ্যাটার্জি বলেন মোদি ও অমিত শাহ প্রধান আদর্শগত শত্রু হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে টার্গেট করেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। কারণ মোদি ও অমিত শাহের রয়েছে স্বল্পমেয়াদি ভিশন, তারা দীর্ঘ মেয়াদি হিসাব না কষেই বিঘ্নকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.