ইস্টার হামলার নিরপেক্ষ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্যাথলিকদের মন জয়ের চেষ্টা গোতাবায়ার

শ্রীলংকা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী গোতাবায়া রাজাপাকসা ক্যাথলিকদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন বলে মনে হচ্ছে, যারা ২১ এপ্রিলের ইস্টার সানডে বোমা হামলার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের তদন্ত নিয়ে অখুশি। ওই হামলায় প্রায় ৩০০ জন নিহত ও ৫০০ আহত হয়।

পার্লামেন্টের ছয়জন বিরোধী ক্যাথলিক এমপি প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনার কাছে হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গোতাবায়া রাজাপাকসা ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি যদি নির্বাচিত হন, তাহলে “শ্রীলংকার ক্যাথলিক চার্চের প্রধান আর্চবিশপ কার্ডিনাল ম্যালকম রঞ্জিতের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তিনি পূরণ করবেন”।

২১ এপ্রিলের হামলার তদন্তে বর্তমান ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশের ব্যাপারে কোন রাখঢাক রাখেননি কার্ডিনাল রঞ্জিত।

সন্ত্রাসী হামলার তদন্তের জন্য বহুল আলোচিত পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটি (পিএসসি) গঠন করে ইউএনপি, কিন্তু এই কমিটির কর্মকাণ্ড নিয়ে শুধু খ্রিস্টানরা নয়, বরং মুসলিমরাও সমালোচনা করেছে। এটাকে মূলত রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ হিসেবে দেখা হচ্ছে, সিরিয়াস কোন তদন্ত প্রচেষ্টা হিসেবে নয়।

চলতি সপ্তাহে দেয়া এক বিবৃতিতে গোতাবায়া আশ্বাস দিয়েছেন যে, এই বিষয়টা তিনি এমনভাবে দেখবেন যাতে সব নাগরিকের সুবিধার্থে দেশ থেকে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়।

গোতাবায়া বলেন, “কার্ডিনাল রঞ্জিতের মনোবেদনার বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে পারি আমি। কারণ নির্দয় বোমা হামলায় নিহত ও আহতদের পরিবারগুলোর ন্যায় বিচারের দাবি এখনও মেটানো হয়নি”।

তিনি আরও বলেন যে, কার্ডিনাল ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা হিসেবে এই অনুরোধ করেননি, বরং সকল শ্রীলংকানের পক্ষ থেকে তিনি এটা বলেছেন।

শ্রীলংকার ৬% ক্যাথলিক সম্প্রদাযের প্রধান কার্ডিনাল ইস্টার সানডের হামলার পর তার ভূমিকার কারণে প্রশংসিত হয়েছেন। বিস্ফোরণের পর মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ঠেকানোর জন্য ভূমিকা রেখে তিনি বড় নেতা হিসেবে প্রশংসিত হন।

তবে, কিছু মুসলিম ও অন্যান্যরা তার ব্যাপারে চরম সমালোচনা করেন, যখন তিনি উগ্র মৌলবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু আথুরিলিয়ে রাথানা থেরোকে দেখতে গিয়েছিলেন। থেরো সে সময় তিনজন মুসলিম রাজনীতিককে বরখাস্তের দাবিতে ক্যান্ডিতে আমরণ অনশনে বসেছিলেন। এই তিনজন রাজনীতিক মুসলিম চরমপন্থার প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন বলে অভিযোগ করা হয়।

কার্ডিনাল রঞ্জিতকে সাধারণভাবে পশ্চিম-বিরোধী সিংহলী জাতীয়তাবাদী হিসেবে দেখা হয়, তবে তিনি সাম্প্রদায়িক নন। এক বিতর্কিত বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে, ২১ এপ্রিল হামলাটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনি অস্ত্র ব্যবসার জন্য পশ্চিমা শক্তিগুলোর সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, অন্য দেশে সঙ্ঘাত উসকে দিয়ে এই দেশগুলো সজিব থাকে। এই ধরনের স্বার্থের সামনে দাবার ঘুঁটিতে পরিণত না হওয়ার জন্য তিনি মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ইস্টার হামলার পরবর্তীতে অদক্ষতা দেখানোর কারণে ইউএনপি সরকারের বিরুদ্ধে রঞ্জিতের কড়া সমালোচনার পাশাপাশি গোতাবায়া ক্যাথলিক ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হামলার স্বাধীন তদন্ত ও বিচারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেটা নির্বাচনের সময়ে তাদের মধ্যে একটা শক্ত আবেদন গড়ে তুলবে। খ্রিস্টান ভোটাররা আগে রাজাপাকসার তেমন জোরালো সমর্থক ছিলেন না।

খ্রিস্টানদেরকে সাধারণভাবে ইউএনপি-পন্থী হিসেবে দেখা হয় কারণ তারা বেশি পশ্চিমা-পন্থী এবং উদারপন্থী। ইউএনপি এবং তাদের পশ্চিমা-পন্থী নেতা রানিল বিক্রমাসিঙ্গেকে সমর্থন দেয়ার ইতিহাস রয়েছে তাদের, কারণ বিক্রমাসিঙ্গের পূর্বপুরুষদের মধ্যে খ্রিস্টান ছিল, যদিও তিনি নিজে একজন বৌদ্ধ। তবে, ইস্টার সানডেতে যে আইএস স্টাইলের হামলা হয়েছে, সেটা খ্রিস্টানদের মধ্যে এমন আতঙ্ক তৈরি করেছে যে, তাদের আগের অবস্থান এবার পাল্টে যেতে পারে। খ্রিস্টানরা হয়তো গোতাবায়াকে ভোট দিতে পারেন।

সফররত ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত আহমেদ শাহিদ আলাদাভাবে রোববার মিডিয়াকে বলেছেন যে, ইস্টার হামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা এখনও মানসিক আঘাতের মধ্যে রয়েছে এবং তিনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো থেকে এই অভিযোগ পেয়েছেন যে, তারা এখন পর্যন্ত যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায়নি।

কলম্বোতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন যে, তিনি ইস্টার বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কয়েকজনের বাড়িতে গিয়েছেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন, ওই ট্রাজেডির পর এই পরিবারগুলো এখনও তাদের জীবন গুছিয়ে উঠতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন যে, ইস্টার সানডে হামলার জবাবে সরকার যে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল, সেটার কারণে কিছু সম্প্রদায়ের লোক তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের রীতিনীতি চর্চা করতে পারেনি।

বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বেড়েছে এবং এ কারনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও সহিংসতা আরও বেড়ে গেছে। শাহিদ আরও বলেন যে, অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, অনেকেই তাদের বিশ্বাসের কারণে হয়রানি এবং দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন।

তবে জাতিসংঘের কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, শ্রীলংকায় বহু ধর্মকে সমন্বয় এবং গ্রহণের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। আইন অনুসারে এখানে একজন ব্যক্তির যে কোন ধর্ম থাকতে পারে, সে যে কোন ধর্ম গ্রহণ এবং পরিবর্তনও করতে পারেন। আর এখানে যে চর্চাটা রয়েছে, সেটা মোটা দাগে আন্তর্জাতিক মানের।

তবে শাহিদ উল্লেখ করেন যে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায় এবং খ্রিস্টান চার্চের অনুসারীরা হয়রানি ও হামলার শিকার হচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে এখানে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে এবং ভুয়া খবর ছড়িয়ে আতঙ্ক বাড়ানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, অনেকে আইন প্রয়োগের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য রাজনীতিবিদদের দায়ি করেছেন। সহিংস হামলার পর আটক অনেককে ছেড়ে দেয়ার জন্য রাজনীতিবিদরা পুলিশকে চাপ দিয়েছিল বলে শোনা গেছে বলেও জানান তিনি।

আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বৌদ্ধ চরমপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব ও নির্বাচনের উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহারের আশঙ্কা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

সফররত জাতিসংঘের কর্মকর্তারা সুপারিশ করেছেন যাতে যারা সহিংসতার জন্য এবং সহিংসতা উসকে দেয়ার জন্য দায়ি তাদের বিরুদ্ধে যেন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং কোন নির্দিষ্ট একটি ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো যেন বন্ধ করা হয়।

তিনি একই সাথে শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের কথা বলেছেন যাতে এর মাধ্যমে পারস্পরিক পরিচয়ের বিষয়ে বোঝাপড়া, শান্তি, সহিষ্ণুতা, লিঙ্গ সমতা এবং মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের ধারণাগুলো লালন করা যায়। আন্ত-ধর্ম সংলাপ চালুর জন্য তিনি বৈরুত ঘোষণা ও এর ১৮টি সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
ভ্যাটিক্যানে পোপের সাথে সস্ত্রীক দেখা করলেন গোতাবায়া রাজাপাকসা

No comments

Powered by Blogger.