সামরিক চুক্তি নিয়ে শ্রীলংকা-যুক্তরাষ্ট্র দর কষাকষি: নজর রাখছে ভারত, চীন by অশ্বিন হেমান্থাগামা

ভারত যখন শ্রীলংকায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে, এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক চুক্তি নিয়ে দর কষাকষিকে কেন্দ্র করে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ রাষ্ট্রটির রাজনীতি আবারও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে।
শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিঙ্গে বুধবার পার্লামেন্টে ঘোষণা দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি সামরিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। ১৯৯৫ সালের স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্টের (সোফা) বদলে এই চুক্তি করা হবে। নতুন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে মার্কিন সামরিক বাহিনী শ্রীলংকায় অবাধ প্রবেশের সুযোগ পাবে।
বিক্রমাসিঙ্গে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে বলেছেন যে, এই চুক্তি শ্রীলংকার সার্বভৌমত্বকে ব্যাহত করবে না। তিনি বলেছেন যে, সমালোচকরা যেমনটা বলছেন, সেখানে চুক্তির অধীনে শ্রীলংকায় ঘাঁটি স্থাপনের কোন সুযোগ পাবে না যুক্তরাষ্ট্র।
কমিউনিস্ট পার্টি জনতা বিমুক্তি পেরামুনা দলের এক এমপির প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিঙ্গে বলেন যে, সোফা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৫ সালে। তৎকালিন প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা এই চুক্তিটি করেছিলেন।
এই চুক্তির অধীনে শ্রীলংকায় মার্কিন সেনাদের কর্মকাণ্ডের ফ্রেমওয়ার্ক নির্ধারণ করা হয়।
অ্যাকুইজিশান অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট (এসিএসএ) নামের আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০০৭ সালে যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন গোতাভায়া রাজাপাকসা। ২০১৭ সালের আগস্টে চুক্তিটিতে কোন ধরনের সংশোধনী ছাড়াই আবার সেটা নবায়ন করা হয়। এসিএসএ চুক্তির অধীনে মার্কিন সামরিক সদস্য ও প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদেরকে কূটনৈতিক সুবিধা দেয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা সম্প্রতি বলেছেন যে, শ্রীলংকায় যুক্তরাষ্ট্র ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে, বা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হতে পারে, এ ধরনের কোন চুক্তি তিনি হতে দিবেন না। তার ওই মন্তব্যের কয়েক দিন পরে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিঙ্গে এ কথা বললেন। চলতি বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বিক্রমাসিঙ্গে।
২১ এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার পর শ্রীলংকার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে, সেটাকে ভারতের প্রতিবেশী দেশে চীনের প্রভাব মোকাবেলার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখছে নয়াদিল্লী।
শ্রীলংকার সাথে যে ধরনের চুক্তির দর কষাকষি চলছে, সে ধরনের চুক্তি ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করেছে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যে চুক্তিটি করেছে, সেটা হলো লজিস্টিক্স এক্সচেঞ্জ মেমোরান্ডাম অব এগ্রিমেন্ট (এলইএমএম)। ২০১৬ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির অধীনে দুই দেশ পরস্পরের সুনির্দিষ্ট কিছু সামরিক ঘাঁটি থেকে জ্বালানি সংগ্রহ, যৌথ মহড়া ও প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারবে।
২০১৮ সালে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেটা হলো কমিউনিকেশান্স কমপ্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (সিসিএসএ)। এই চুক্তির অধীনে দুই দেশের সামরিক বাহিনী এনক্রিপ্টেড তথ্য আদান প্রদান করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জাম কিনতে পারবে ভারত।
শ্রীলংকায় যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতা চীনের দৃষ্টির অগোচরে নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের একটা উদ্বেগ হলো চীন শ্রীলংকায় বন্দর ও অন্যান্য প্রকল্পে তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়েছে, যেটা বেইজিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ। চীন শ্রীলংকাকে ঋণসহ অন্যান্য আর্থিক সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
২০১৭ সালে শ্রীলংকা তাদের কৌশলগত হামবানতোতা বন্দরটি ৯৯ বছরের লিজ হিসেবে চীনের হাতে তুলে দেয়। ১.৪ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটির ঋণ পরিশোধের অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ নেয় শ্রীলংকা। বিশ্বের ব্যস্ততম পূর্ব-পশ্চিম নৌ পরিবহন রুটের উপরেই হামবানতোতা বন্দরের অবস্থান এবং এর মাধ্যমে এ অঞ্চলে চীনের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে, যেটা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় আধিপত্যের জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিল।
এইসব ঘটনাপ্রবাহ থেকে শ্রীলংকায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে, যেখানে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে ভারত।

No comments

Powered by Blogger.