দেশি-বিদেশী হুমকির মধ্যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী অনুসন্ধানে ব্যস্ত শ্রীলংকা

মাহিন্দা রাজাপাকসা ও মৈত্রিপালা সিরিসেনা
শ্রীলংকার বুদ্ধিজীবী থেকে সড়কের পরিচ্ছন্নতা কর্মী পর্যন্ত সবার মনে এখন একটিই প্রশ্ন: কখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে, আর কেই বা দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী?

সরকারের প্রতিটি কাজ নিয়ে আরো হাজারো প্রশ্ন থাকলেও শ্রীলংকাবাসীর মনে সর্বশেষ যে আতংক ভর করেছে তা হলো দ্বীপদেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা। এর সঙ্গে জড়িত প্রশ্নটি হলো আমেরিকান ঘাঁটি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে রাজনীকিদের কোন দলটি বেশি দেশপ্রেমিক।

লংকান ভোটাররা এখন দেখছেন: যে মৈত্রিপালা সিরিসেনাকে তারা প্রেসিডেন্ট পদে ভোট দিয়েছিলেন তিনিই এখন ওই লোকের সঙ্গে হাত মেলানোর চেষ্টা করছেন যাকে তিনি ২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় একজন শঠ ও স্বৈরাচার হিসেবে নিন্দা করেছিলেন।

২০১৮ সালের অক্টোবরে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ও ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা রানিল বিক্রমাসিঙ্ঘেকে বরখাস্ত করে মাহিন্দা রাজাপাকসাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে নতুন সরকার গঠনের চেষ্টা করেছিলেন সিরিসেনা।

স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট বিক্রমাসিঙ্ঘেকে পুনর্বহাল করলেও তার সরকার গত পাঁচ বছরে সুসাশনের ভালো কোন উদাহরণ তৈরি করতে পারেনি। লিবারেল হিসেবে পরিচিত বিক্রমাসিঙ্ঘে কুখ্যাতি রয়েছে ভিন্নমত পোষণকারীর প্রতি অসহিষ্ণু ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন বলে। ইউএনপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অতিরিক্ত মেয়াদ তিনি ক্ষমতায় রয়েছেন। তাছাড়া দেশের শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সংহতি জোরদার করার ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে ইউএনপি’র কোন ইতিহাস নেই, যদিও এখন দলটি শান্তিকামী লবির পছন্দ।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তামিলরাও ভুলে গেছে যে ১৯৮৩ সালের কালো জুলাইয়ে যখন তামিল বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয় তখন তারা ইউএনপি’র শাসনেই ছিলো। উত্তর শ্রীলংকায় আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের ৩০ বছরব্যাপী যুদ্ধের সূচনা ছিলো সেটি।

তাই ইউএনপি ব্রান্ডের শান্তি খুবই সন্দেহজনক। ২০০২ সালে বিক্রমাসিঙ্ঘের নেতৃত্বে ইউএনপি সরকার যখন শন্তি প্রক্রিয়া শুরু করে তখনই এলটিটিই নিজেকে সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়। আজ ১৭ বছর পর মনে হচ্ছে শ্রীলংকা আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে এবং তামিলদের সঙ্গে মূল সংঘাতের নিরসন হয়নি। পাঁচ বছর আগে ইউএনপি ও সিরিসেনা দেশের ‍উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলকে অধিকতর ক্ষমতা দিয়ে সংবিধান পরিবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা আজো অপূর্ণ রয়ে গেছে।

এখন নতুন এবং সমানতালে বিপজ্জনক পরিস্থিতি হাজির হওয়ায় তামিল সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রশ্নটি পেছনে পড়ে গেছে। সংখ্যাগুরু সিনহলিরা এখন লেগেছে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে।

আইএসের প্রতি সহানুভুতিশীল লংকান মুসলিমদের দ্বারা ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডের হামলা সারা দেশে সিনহলি-মুসলিম সংঘাত উষ্কে দিয়েছে।

এখন ইস্টার হামলা ও এর পরবর্তী ঘটনাবলী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের আরেকটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনী সুবিধা লাভের জন্য রাজনৈতিক ইন্ধনে সাম্প্রদায়িকতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। কিছু আইনগত সমস্যা মিটে গেলে একই সময়ে হয়তো প্রাদেশিক নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সংসদ নির্বাচনের সময় এসে যাবে। তাই সংখ্যাগুরু সিনহলিদের মধ্যে সমর্থন ভিত্তি মজবুত করতে কিছু গ্রুপ মুসলিম-বিরোধী উত্তেজনায় ইন্ধন দিচ্ছে।

ইসলাম সহিংসতায় বিশ্বাস করে না – এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হোক এটা আন্তরিকভাবে কোন রাজনীতিবিদই চান না। ফলে দ্বীপদেশটির অনেক জায়গায় মুসলিম ব্যবসায়ীদের বয়কট অব্যাহত রয়েছে।

মুসলিম চরমপন্থাও কার্যকরভাবে দমন করা যায়নি। উপর্যুপরি সরকারগুলো ধর্মীয় চরমপন্থা প্রতিরোধ এবং অল সিলন জামিতু উলামা (এসিজেইউ)’র মতো ধর্মীয় সংগঠনগুলোর উপর নজরদারি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এসিজেইউ শ্রীলংকার ঐতিহ্যবাহী সুফি মুসলমানদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন।

গত ২০ বছর ধরে এক লোকের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এসিজেইউ এবং এই সংগঠনটি ওহাবি, সালাফি, তাবলিগ, দেওবন্দী, ইখওয়ান ও তাওহিদের মতো মুসলিম মৌলবাদী গ্রুপগুলোকে আমদানি করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। যার পরিণতি ছিলো ২১ এপ্রিলের ধ্বংসযজ্ঞ।

বৌদ্ধ চরমপন্থীদের দৌরাত্মও বাড়ছে। কিন্তু এদেরকে প্রতিরোধের মতো শক্তিশালী বলে প্রমাণ দিতে পারেনি বর্তমান সরকার বা রাজাপাকসা শাসন। দুই মাস আগে প্রেসিডেন্টের ক্ষমায় মুক্তি পান বোদু বালা সেনা (বিবিএস) সাধারণ সম্পাদক নানাসারা থেরো। আদালত অবমাননার দায়ে তার ছয় বছর কারাদণ্ড হয়েছিলো। তখন থেকে তিনি শ্রীলংকায় ‘বৌদ্ধ যাজকতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ইউএনপি সূত্র জানায় যে একটি বৃহত্তর জোট গঠনের পর শরিক দলগুলোর সম্মতি নিয়ে তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই করা হবে। আগামী মাসের শুরুতে এই জোট গঠিত হতে পারে। তবে পছন্দ হিসেবে এখন পর্যন্ত দু’জনের নাম শোনা যায়: দলের উপনেতা সাজিথ প্রেমাদাসা ও পার্লামেন্টের স্পিকার কারু জয়সুরিয়া। তবে নির্দলীয় ব্যক্তি ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ধামিকা পেরেরাকে বিক্রমাসিঙ্ঘের পছন্দ বলে জানা গেছে।

শ্রীলংকা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে গোতাভায়া রাজাপাকসার নাম প্রচার করা হচ্ছে। দুবছর আগে দলটি গঠন করেন মাহিন্দা রাজাপাকসা। তবে গোতাভায়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। রাজাপাকসা পরিবার থেকে তার বিকল্পও দেয়া হতে পারে।

যারা আমেরিকান নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে চান তাদের নামের ত্রৈমাসিক তালিকায় গোতাভায়ার নাম আসেনি বলে মিডিয়ার খবরে জানা গেছে। এমন গুজব রটেছে যে সাবেক এই প্রতিরক্ষা সচিবের শরীর খারাপ। বিশেষ করে তার হার্টের সার্জারি হওয়ার পর। এ কারণে তিনি বেশ কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলেন।

১৩ মে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনাল রেভেনিউ সার্ভিস (আইআরএস) একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যাদের আমেরিকান নাগরিকত্বের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে বা যারা নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে চান। সেখানে গোতাভায়ার নাম নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকত্ব পরিত্যাগের অনুরোধ রাখবে না এমনটা কখনোই মনে করেননি রাজাপাকসা পরিবারের এই সিনিয়র সদস্য।

No comments

Powered by Blogger.