কেমন আছে রাজীবের দুই ভাই by মরিয়ম চম্পা

দুই বাসের চাপায় প্রথমে হাত হারানো ও পরে নিহত রাজীবের সেই ঘটনার এক বছর আজ। গত বছর ৩রা এপ্রিল দুপুর। প্রতি দিনের মতো বিআরটিসি বাসে চড়ে কলেজে যাচ্ছিলেন রাজীব হোসেন। মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন রাজীব। বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়ানো রাজীবের হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে স্বজন পরিবহন নামের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিকে গা ঘেঁষে চাপা দেয়। এসময় কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পথচারীরা দ্রুত তাঁকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যায়।
প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাজীবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সাময়িক উন্নতির পর তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা চেষ্টা করেও বিচ্ছিন্ন সে হাতটি রাজীবের শরীরে আর জুড়ে দিতে পারেননি। দীর্ঘ ১২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১৬ এপ্রিল রাত ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর পটুয়াখালীর বাউফলের ছেলে রাজীব ও তার ছোট দুই ভাই খালা-মামাদের তত্ত্বাবধানেই বেড়ে ওঠেন।
রাজীবের পরে একই বছর ডান হাত হারান বাসের কন্ডাক্টর হৃদয়, পা হারান গৃহপরিচারিকা রোজিনা ও গাড়িচালক রাসেলসহ অনেকেই। দুর্ঘটনার কাতারে যুক্ত হয় আহত ও নিহতদের অসংখ্য তালিকা। যেন প্রচন্ড অভিমান নিয়ে সবাইকে দোষী এবং অপরাধী করে চলে যায় রাজীব ও রোজিনা। রাজীবের দুর্ঘটনার ১ বছর। মাস গড়িয়ে বছর হলেও কেউ মনে রাখেনি রাজীবদের। শুরুতে রাজীবের এতিম দুই ভাইয়ের দায়ীত্ব নেয়ার কথা বলে মিডিয়ায় আলোচনা আসেন অনেকেই। প্রতিশ্রুতি দেন এলাকায় তার নামে রাস্তা, মাদ্রাসা ও টিউবওয়েলসহ অনেক কিছু তৈরি করার। এদের তালিকায় চিত্র নায়ক অনন্ত জলিল থেকে শুরু করে ছিলেন তৎকালিন সরকারের অনেক কর্তা ব্যক্তিরা। ছিলো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান।
মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় রাজীবের ছোট খালা খাদিজা বেগম লিপি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বলেন, আজকের দিনেই ঘাতক বাস প্রথমে রাজীবের হাত এরপর তার জীবনটাই কেড়ে নেয়। অনেকে অনেক কিছু বলেছে। দিয়েছে প্রতিশ্রুতি। কোর্ট বলেছে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপুরণ দেয়া হবে। রাজীবের দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নেয়া হবে। কোনো কিছুই হয়নি। সব আগের মতোই আছে। এখন পর্যন্ত মামলার সুষ্ঠু নিষ্পত্তি এবং ঘাতক চালকের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। রাজীবের লাশ মাটি দেয়ার জন্য এলাকায় নিয়ে গেলে ওখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান বলেছিল তার নামে এলাকায় একটি সড়ক পাকা করে দেয়া হবে। যার নাম হবে রাজীব সড়ক। সেটাও করেনি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেছে বাড়িতে রাজীবের নামে একটি টিউবওয়েল বরাদ্দ দিবেন। যেটা থেকে এলাকার লোকেরা পানি খাবেন। সেটাও দেয়া হয়নি। পটুয়াখালী-২ আসনের এমপি সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ রাজীবের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে বলেছেন রাজীবের নামে এলাকায় একটি মাদ্রাসা করে দিবেন। কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। গত ৬ মাস ধরে ক্ষতিপূরনের রিট মামলার শুনানি হচ্ছে না। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর শুধু দু’বার শুনানি হয়েছে। ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টের রিটের কার্যক্রমও স্থবির। ঘাতক বাস চালকের সাজা হলে আমরা অন্তত মানসিকভাবে শান্তি পাবো। মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত পরিপূর্ণ বিচার আমরা পাবো না।
তিনি বলেন, অনেকেই বলেছে রাজীবের দুই ভাইয়ের যাবতীয় খরচ বহন করবে। কেউই তা করেনি। ওদের দুজনের সকল খরচ আমরা মামা খালারাই চালাচ্ছি। আমরা চাচ্ছি আদালত যদি ক্ষতিপূরণের রিটটি দ্রুত নিস্পত্তি করে তাহলে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ যে টাকাটা পাওয়া যাবে সেটা দিয়ে ওদের পড়ালেখা এবং ভবিষ্যত ভালোভাবে নিশ্চিত করা যাবে। যাত্রাবাড়ি তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় রাজীবের মেজো ভাই মেহেদী হাসান অষ্টম শ্রেণীতে ও ছোট ভাই আব্দুল্লাহ সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। মাদ্রাসার হোস্টেলেই তারা থাকে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারের যথাযথ পদেক্ষপ এবং চালকের সচেতনতা ব্যতিত সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। রাজীবের দুর্ঘটনাটি ছিল দুই বাসের রেসারেসি এবং চালকের পুরোপুরি ইচ্ছাকৃত। সে গাড়ির ভেতরে ছিল। রাস্তায় ছিল না। গাড়ির ভেতরে থাকাবস্থায় রাজীব হাত হারিয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন গাড়ির মালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সচেতন না হলে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলবে। আমরা চাই রাজীবের মতো আর কোনো মায়ের বুক যেনো খালি না হয়। আমাদের মতো কোনো রাজীবকে যেন তাদের হারাতে না হয়। দুর থেকে অনেকেই সমবেদনা জানালেও আমরা সারা জীবনের জন্য হৃদয়ের ধন রাজীবকে হারিয়েছি। এখনো প্রতিটি মূহুর্ত ওর কথা, ওর চেহারা, ওর হাঁসি মনে করে কাঁদি। একটি ভালো খাবার বিশেষ করে ওর পছন্দের কোনো খাবার রান্না করলে মুখে তুলতে পারি না। ভাবি আজ রাজীব বেঁচে থাকলে ওকে ফোন করে ডাকতাম। ও এসে খেত। কিন্তু ও তো আর আমাদের কাছে কোনো দিন আসবে না। ওর সেই লাজুক ও মধুর হাঁসিটা আমরা কোনো দিন ভুলবো না।

No comments

Powered by Blogger.