অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সোহেল রানা by রুদ্র মিজান

ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ১৬৮ ঘণ্টা। পেরিয়ে গেছে সাত দিন। জ্ঞান ফিরেনি ফায়ারম্যান সোহেল রানার। অন্যদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষিরা মনে করেন দেশের বাইরে  উন্নত চিকিৎসা পেলে হয়তো দ্রুত সুস্থ হতেন তিনি। কিন্তু সেই সাধ্য নেই দরিদ্র কৃষক পরিবারের। তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে কে? এই সংকটাপন্ন অবস্থায় সরকারের দিকে তাকিয়ে সোহেল রানার পরিবার।
দুর্ঘটনাটি ঘটে গত ২৮শে মার্চ। সেদিন দুপুরে আগুন লাগে বনানীর এফ আর টাওয়ারে। কল পাওয়া মাত্রই ফায়ার  সার্ভিসের কুর্মিটোলা স্টেশন থেকে দ্রুত তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। একটি ইউনিটে ছিলেন ফায়ারম্যান সোহেল রানা। বহুতল ভবনে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কাঁচের ভাঙ্গা জানাল দিয়ে হাত নেড়ে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন আটকে পড়ে মানুষ। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছেন তারা। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেন। সেই যুদ্ধে অংশ নেন সোহেল রানা। একপর্যায়ে ল্যাডার (উঁচু মই) দিয়ে বহুতল ভবন থেকে আটকে পড়া নর-নারীদের উদ্ধার করতে থাকেন তিনি। একে একে চার জনকে উদ্ধার করেন সফলভাবে। তারপরই ঘটে দুর্ঘটনাটি। ল্যাডারের বাস্কেটে তখন উদ্ধারকরা পাঁচ-ছয় জন। তাদের নামাতে যাবেন। ঠিক তখনই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ল্যাডারটি বন্ধ হয়ে যায়। ‘মাগো’ বলে একটা চিৎকার করেন সোহেল রানা। তার পা আটকে যায় ল্যাডারে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে যায় ডান পা। টান পড়ে কোমড়ে বাঁধা তার সেফটি হুকে। নাড়িভুড়ি যেন বের হয়ে যাচ্ছিলো। অজ্ঞান হয়ে যান সোহেল রানা। রক্তে ভেসে যায় চারপাশ।
কুর্মিটোল ফায়ার স্টেশনের  সিনিয়র স্টেশন অফিসার সুশান্ত মন্ডল জানান, ল্যাডার নিয়ে আটকে পড়া কয়েকজনকে উদ্ধার করে নিচে নামাচ্ছিলো সোহেল রানা। কিন্তু ল্যাডারে সবার জায়গা হচ্ছিল না। আটকে পড়াদের জায়গা করে দিতে সোহেল রানা ল্যাডারের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলো। কিন্তু ল্যাডারটি যখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিচের দিকে নেমে আসছিল, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ক্লোজ হয়ে যাচ্ছিলো। তখনই হঠাৎ করে সোহেল রানার পা ল্যাডারের ভেতরে আটকে দুর্ঘটনাটি ঘটে। তারপর সহকর্মীরা তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যান। এখন পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। সিএমএইচের আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে তাকে।
খবর পেয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন সোহেল রানার মা-বাবা, ভাই-বোন। সোহেল রানার ভগ্নিপতি জসিম উদ্দিন মানবজমিনকে জানান, আহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোনে কল দিয়ে সোহেল বলেছিলেন, ‘দুলা ভাই আমি শেষ।’ তারপরই সংজ্ঞা হারান তিনি। চিকিৎসকরা গতকাল জানিয়েছেন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর আগে উন্নতির কথা বললেও সেই কথা আর শোনাচ্ছেন না চিকিৎসকরা। জসিম উদ্দিন বলেন, সোহেল রানা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। উন্নত চিকিৎসা পেলে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ তাকে দেশের বাইরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হোক।
সোহেল রানার সহকর্মীরা জানান, সিএমএইচে সোহেল রানার শরীরে দু’টি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। অপারেশনের পর থেকে এ পর্যন্ত সোহেল রানাকে ২১ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। রক্ত দিতে সবসময় প্রস্তুত তার সহকর্মীরা। তারা আশা করছেন প্রিয় সহকর্মীটি আবার সুস্থ হয়ে ফিরবে।
সোহেল রান্নার ভগ্নিপতি জসিম উদ্দিন জানান,  কৃষক পরিবারের সন্তান সোহেল রানা। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। বড়  এবং একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছে জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। ছোট তিন ভাই লেখাপড়া করছেন। বিবিএ অধ্যয়ণরত উজ্জ্বল, একাদশ শ্রেণির ছাত্র রুবেল ও দশম শ্রেণিতে অধ্যয়ণরত দেলোয়ার। বাবা নুরুল ইসলাম একজন দরিদ্র কৃষক, মা গৃহিনী হালিমা আক্তার। হাওর অঞ্চলের এই দরিদ্র কৃষক পরিবারের হাল ধরেছিলেন সোহেল রানা। কিশোরগঞ্জের ইটনার চৌগাংগা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তারপরই ২০১৫ সালে ফায়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সে। গত বছর থেকেই পরিবার থেকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছিলো তাকে। কিন্তু সোহেল রানা জানান, এখন বিয়ে করবেন না। এ বিষয়ে জসিম উদ্দিন জানান, সোহেল অল্প টাকা বেতন পান।
এই বেতনে মা-বাবা ও ভাইদের খাবার, লেখাপড়ার ব্যয় বহন করাই কঠিন। বিয়ে করলে নিজের সংসার চালাতে গিয়ে মা-বাবার সেবা করা হবে না। মা-বাবাকে আর্থিক কষ্ট দিতে চান না তিনি। তাই বিয়ের পরিকল্পনা থেকে দুরে ছিলেন। সোহেল রানা ছোটবেলা থেকেই অন্যের বিপদে সহযোগিতা করতে ভালোবাসতেন। তাই পেশা হিসেবে বেছে নেন গতি, সেবা ও ত্যাগের সেবাধর্মী সরকারি প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের ফায়ারম্যান। সেবাদিতে গিয়ে, মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে এখন নিজেই লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। গুরুতর আহত সোহেল রানার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার কেওরালা গ্রামে।

No comments

Powered by Blogger.