সুরমা মার্কেটে পুলিশের ‘চোখ’

দিন হলেই বদলে যায় সিলেটের সুরমা মার্কেটের পরিবেশ। উঠতি বয়সী যুবকদের ভিড় লেগেই থাকে মার্কেটের দু’টি আবাসিক  হোটেলে। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এতে অতিষ্ঠ। প্রতিবাদ করলে বাড়ে পুলিশি ঝামেলা। হুমকিও আসে বিভিন্ন তরফ থেকে। এ কারণে কোনো ব্যবসায়ী মুখ  খোলেন না। চোখের সামনে অনেক কিছু ঘটলেও তারা নির্বিকার। এই মার্কেটে এবার ‘চোখ’ পড়েছে সিলেট পুলিশের।
এক রাতের অভিযানে দু’টি আবাসিক হোটেল থেকে আটক করা হয়েছে ৬ রমণীকে। তাদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছে হোতারাও। গতকাল গোটা মার্কেটে আলোচনায় ছিল পুলিশের অভিযান। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- প্রায়ই অভিযান হয় সুরমা মার্কেটে। দু’-একদিন বন্ধ থাকে। এরপর আবারো পুরনো দৃশ্য। সিলেট নগরীর প্রাচীন মার্কেট ‘সুরমা মার্কেট’। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ওই মার্কেটের অবস্থান। কীন ব্রিজে ঢোকার মুহূর্তে ডানপাশে সুরমা মার্কেট। এ মার্কেটের ভেতরের অংশে নিউ সুরমা রেস্ট হাউস। বাইরের অংশে বদরুল রেস্ট হাউস। দু’টি আবাসিক হোটেল সিলেট শহরে পরিচিত ভিন্ন নামে। অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য পরিচিত। সিলেট মহানগর পুলিশের উত্তরের ডিসি আজবাহার আলী শেখের কাছে এ দুই আবাসিক হোটেল নিয়ে একাধিক অভিযোগ। নামে-বেনামে এসব অভিযোগ দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে ছদ্মবেশে সুরমা মার্কেটে যান ডিসি আজবাহার। তিনি নিজে গিয়েও অভিযোগের সত্যতা পান। এর পরপরই পুলিশের কয়েকটি টিম একসঙ্গে অভিযান চালায় দু’টি হোটেলে। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী অভিযানে ৬ নারী সহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে- নিউ সুরমা আবাসিক হোটেলের সাব-ম্যানেজার কামরুল ইসলাম, স্থানীয় ফুটপাতের দোকানি দেলোয়ার হোসেন কালু, জালালাবাদ এলাকার আমিনুল ইসলাম, বরিশাল মেহেন্দী গঞ্জের সুমি আক্তার, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আঁখি আক্তার, হবিগঞ্জের রাশিদা প্রকাশ আসমা, পটুয়াখালীর আঁখি, কুমিল্লার মুরাদ নগরের রিতা আক্তার, পাবনার আতাইকুলার হাসনা আক্তার ও বদরুল রেস্ট হাউসের ম্যানেজার সমীরণ দাশ। অভিযানের পর সিলেট মহানগর পুলিশের ডিসি আজবাহার আলী শেখ সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘদিন থেকে সুরমা মার্কেটের এই দুটি আবাসিক হোটেলে অসামাজিকতা চলছে। তাই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযানে তাদের আটক করা সম্ভব হয়েছে।
এদের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলবে। এদিকে- অভিযানে আটককৃত ১০ জনের বিরুদ্ধে গতকাল সিলেটের কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন কোতোয়ালি থানার এসআই আকবর হোসাইন। গতকাল বিকালে ১৯৩৩ সালের নীতিহীন ব্যবসা আইন, নারীদের  বেশ্যা হিসেবে ভাড়ায় আনয়ন ও কাজে নিয়োজিত করার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়। সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিকালে পুলিশের এজাহার ফিরিয়ে দিয়ে ধারা সংশোধন করে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- সুরমা মার্কেটের নিউ সুরমা আবাসিক হোটেলের মালিক হচ্ছেন সিলেটের কারাবন্দি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা উসমান আলী।
তিনি দোয়ারাবাজারের আজরফ নামের এক ব্যক্তিকে হোটেল ভাড়া দিয়েছেন। হোটেলের ম্যানেজার আব্বাস। শুক্রবার রাতে অভিযানের সময় আব্বাস পালিয়ে যায়। অভিযানকালে উপস্থিত মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- নিউ সুরমা হোটেলের নিয়ন্ত্রক আজরফ আগে হোটেল বিলাসের বয় ছিলো। এরপর সে সিলেটে মজলিস বোর্ডিং, তায়েফ বোর্ডিংয়েও চাকরি করেছে। রাতের অভিযানের সময় নিউ সুরমা হোটেলে থাকা রমণীদের বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি করা একটি কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। পুলিশ কেবল মাত্র ওই হোটেলের একটি কক্ষ থেকে একজন মহিলাকে আটক করেছে।
অভিযানে  টের পেয়ে এসব মহিলাদের ওই বিশেষ ঘরে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। আটকের পর নিউ সুরমা হোটেলের সাব ম্যানেজার কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- তারা হোটেলে অবৈধ ব্যবসা করলেও পুলিশকে মোটা অঙ্কের টাকা দেন। এর মধ্যে প্রতিমাসে কোতোয়ালি থানার ওসি’র তহবিলে যায় ২৫ হাজার টাকা, এসি’র তহবিলে যায় ১০ হাজার টাকা, ওসি তদন্তের তহবিলে যায় ৮ হাজার টাকা, গোয়েন্দা পুলিশকে দেয়া হয় ২৫ হাজার টাকা। এর বাইরেও তারা প্রতিদিন টহলে থাকা পুলিশ দলকেও টাকা দিয়ে থাকেন। একই কথা জানিয়েছেন বদরুল রেস্ট হাউসের ম্যানেজার সমীরণ দাশ। তিনি বলেন- পুলিশকে টাকা দিয়েই তারা ব্যবসা চালাচ্ছেন। সুরমা মার্কেটের চারটি গেইট রয়েছে। প্রতিটি গেইটে তারা দিনে ও রাতে ৪ জন করে পাহারাদার রাখেন। পুলিশ মার্কেটের ভেতরে ঢুকলেই তারা হোটেল খালি করে দেন। তিনি বলেন- পুলিশ তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়, আবার অভিযানও চালায়।
এদিকে- ডিসি আজবাহার আলী শেখের আগে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ উত্তরের ডিসি ছিলেন ফয়সল মাহমুদ। তিনিও গত বছরের ৭ই জুলাই সুরমা মার্কেটের ওই দু’টি আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়েছিলেন। ওই সময় ডিসি ফয়সল মাহমুদ তালা ভেঙে দু’টি হোটেল থেকে অসামাজিক কাজে নিয়োজিত থাকা মহিলা ও মূল হোতাদের গ্রেপ্তার করেছিলেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- ওই অভিযানের পর কয়েকদিন মার্কেটের পরিবেশ স্বাভাবিক ছিলো। এরপর থানা ও ফাঁড়ি পুলিশকে ম্যানেজ করে ফের ব্যবসা শুরু করে দুই হোটেলের নিয়ন্ত্রকরা। অসামাজিক কাজের আড়ালে ইয়াবা বিক্রি করা হয় ওই দু’টি হোটেলে। তবে- পুলিশের অভিযানে কোনো মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.