টিভি দেখা বন্ধ করুন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামান by জাবেদ নাকভি

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জর্জ পারকোভিচ যে মন্ত্র দিয়েছেন তাই আমি কায়মনোবাক্যে জঁপছিলাম। এবং সে মতে কয়েক বছর বা তারও বেশি সময় আমি ভারতীয় টিভির খবর দেখি নি। আমি একই পরামর্শ দিয়েছি আমার পাকিস্তানি বন্ধুদের। বলেছি তাদের টিভিও বন্ধ রাখতে।
সুখ্যাত প্রতিরক্ষা বিষয়ক এই বিশ্লেষক নতুন একটি বই লিখেছেন। তার বিষয়বস্তু দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দেশের মধ্যে অসমাপ্ত ও ভয়ানক শত্রুতামুলক সম্পর্ক নিয়ে। এই দুটি দেশের মধ্যে যখন পরিহারযোগ্য একটি সামরিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় ঠিক তেমন এক উত্তেজনাকর সময়ে দিল্লি এসেছিলেন তিনি। ভারতের পারমাণবিক নীতির ওপর তিনি মৌলিক বইয়ের লেখক।
তার বইটি প্রমোট করতে দিল্লি এসেছিলেন।
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- এমন কিছু কি আছে যা উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে পারে। জবাবে তিনি বলেছিলেন, টিভির প্লাগটি খুলে ফেলুন। সীমান্তের দু’পাশেই আমার বন্ধুদের কাছে এই উপদেশ ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে।
যদি দুই পক্ষের কট্টর জাতীয়তাবাদী সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের প্রস্তাব করা হয় পারমাণবিক যুদ্ধ শুরুর এবং শারদ মাস্টার নরেন্দ্র নাথ ধরের সুখকর ‘মিয়া কি তোড়ি’ (ভারতীয় ক্লাসিক্যাল গান) শুনতে দেয়া হয় কোনো এক রোববার সকালের মাহফিলেÑ তাহলে বেছে নিন দ্বিতীয়টি।
যদি নেভি সিলের মতো অপারেশনে বৈদেশিক টার্গেট উপড়ে ফেলা হয় এবং এ সংক্রান্ত উন্মত্ত পরামর্শে উপস্থাপক উদ্বেলিত হন, যদি ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে বিনায়ক তোরভি একটি বাগেশ্বরী পরিবেশন করেন দুটি মারাঠি আভাঙ শেষে তা করা হয়Ñ যদি তা পরিবেশন করেন ঋষি তুকারাম, হালে শুনুন তোরভিকে।
একটি বাস্তব অথবা কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে কা-জ্ঞানহীনের চিৎকারের চেয়ে যদি দুর্দশা ভাগাভাগি করার পন্থাটি কম গুরুত্ব পায় কারো কাছে। যারা কনসার্টে যাচ্ছেন অথবা মুভি দেখতে যাচ্ছেন তারা অন্যদিনে কাশ্মিরের পালওয়ামাতে আধা সামরিক বাহিনীর ওপর চালানো ভয়াবহ নৃশংসতার বিষয়ে অবহিত নন অথবা এ বিষয়ে তারা অভ্যস্ত নন।
আম্মা ও লক্ষেèৗয়ের অন্য নারীরা তাদের সবচেয়ে সেরা স্বর্ণালঙ্কার নীরবে জমা দিয়েছেন জাতীয় তহবিলে। কারণ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওয়াহারলাল নেহরু চীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে এমনটা করতে ব্রিফিং করেছিলেন।
এর ২৫ বছর পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী করমর্দন করেছিলেন চীনের সাবেক নেতা দেং সিয়াওপিংয়ের সঙ্গে। এটা ছিল এক ঐতিহাসিক করমর্দন। ব্যতিক্রম হলো, কেউ একজনের দেয়া একটি স্ক্রিপ্টে ঠোঁট মিলালেন টিভির উপস্থাপক। যখন বিষয়টি অসাড় হয়ে যায়, যেমনটা বর্তমানের দিনকালেও আছে, তখন খবরগুলো হয়ে পড়ে ক্ষণক্ষণে উপদেশ।
যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আগ্রাসন চালালো, তখন টিভি উপস্থাপকদের তার যথার্থতা বিবেচনা না করে উপস্থাপন করে যেতে হয়েছিল। কাতার মালিকানাধীন আল জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল তার উদারতার বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখে ধর্মনিরপেক্ষ সিরিয়ার বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোাঁড়াদের বর্ণনা প্রচার করে। মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভবত এমন রাষ্ট্র ওই একটিই ছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পন্সর করা সার্ক বিষয়ক একটি ডকুমেন্টারির জন্য টিভি ফুটেজ ধারণ করতে আমি ১৯৯৭ সালের ১৪ই আগস্ট লাহোরে ছিলাম। গুজরালের যুগে, এমন ধারণা করা সম্ভব ছিল এবং অবশ্যই সব প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রাতারাতি আকস্মিকভাবে উন্নত হয়েছিল।
ওইদিনটি লাহোরে একটা বাজে দিন ছিল। তাই আমি হোটেল রুমে একটি পাকিস্তানি বিনোদন জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল খুললাম। দেশটির স্বাধীনতা দিবসের ওপর একটি নাটক চলছিল টেলিভিশনে। এতে দেখানো হচ্ছিল উদগ্রীব তরুণ ছাত্ররা মাথায় ফেজটুপি পরে ১৯৪৫ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্য শুনছে।
দৃশ্যটি কেটে নেয়া হয়েছে কংগ্রেস পার্টিতে। কংগ্রেসের ভিলেনের মতো দেখতে একজন কর্মীকে শোনা গেল তার খাদি-পোশাক পরা সহকর্মীদের বলছেন, লালাজি, যদি আমার সামনে পথ থাকতো তাহলে আমি সম্প্রতি হিরোশিমাকে ধ্বংস করে দেয়ার মতো করে একটি এটম বোমা ফেলতাম ওইসব মুসলিমদের মাথার ওপর।
মহাত্মা গান্ধী নেতৃত্বাধীন দল সম্পর্কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে এমনটাই বলা হয়। মহাত্মা গান্ধী হলেন সেই মানুষ, যিনি চেয়েছিলেন জিন্নাহ হবেন প্রধানমন্ত্রী, যদি তাতে ভারত একীভূত থাকে।
দিল্লি ফিরে এসে আমি কাশ্মিরের ওপর একটি টেভিলিশন নাটক দেখছিলাম। এটা হলো অন্য পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা। একজন সুন্দরী যুবতী তার প্রিয়তমের কানের কাছে এসে কিছু বলছেন। তার প্রেমিকটি সংশোধিত একজন জঙ্গি। তার কানের কাছে গিয়ে ওই যুবতী বলছেন, তিনি অস্ত্র ত্যাগ করার কারণে কত খুশি হয়েছেন। কিভাবে মাদকাসক্তি ত্যাগ করার কারণে তিনি কত খুশি হয়েছেন। এসব ওই যুবকের ভিতর প্রবেশ করিয়েছিল অশুভ মানসিকতার লোকজন। আর এর ফলেই তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ওই যুবতী বলছিলেন, ‘সরকার এখন আমাদেরকে এই জমি দিয়েছে আপেল চাষ করার জন্য এবং সুখী জীবন যাপনের জন্য। ’
১৯৯৭ সালে ভারত যে প্রচারণা চালায় তা হলো, মাদকাসক্তির ফলে অথবা ওই রকম বিভিন্ন কারণে কাশ্মির অঞ্চলে সহিংসতা দেখা দেয়।  আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম টিভির খবর দেখবো না।
সোমবার মাত্র দুই মিনিটের জন্য আমি টিভি খুলেছিলাম। একটি চ্যানেলে দেখানো হলো, বোরকা পরা নারীরা পাকিস্তানি পতাকা পোড়াচ্ছেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি পালওয়ামায় প্রাণহানীর প্রতিশোধ নেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। এমন ক্ষুব্ধ হওয়ায় অন্যায় কিছুই নেই।
ভারতের চলচ্চিত্র জগতের দম্পতি জাভেদ আখতার ও শাবানা আজমীর করাচি সফরে যাওয়ার কথা ছিল একটি সাহিত্য আসরে। কিন্তু তারা সেই সফর বাতিল করে দিয়েছেন। তাদের চেয়ে স্পষ্টতই এসব নারী কম দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। কাশ্মির নিয়ে ক্ষোভের কারণে সব রকম সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে খর্ব করার দাবি জানিয়েছিলেন অভিনেত্রী শাবানা আজমী।
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এবং সরদার জাফরি হয়তো কবরে ফিরে যাবেন। এমনকি ভারতীয় নেতারা হয়তো এমন মুহূর্তে সুস্থ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, দ্বিপক্ষীয় শান্তি আলোচনাকে কক্ষচ্যুত হতে দেয়া উচিত নয় সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এটাই।
যেহেতু তা ছুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয় নি, তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইমরান খান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে শক্ত করে ধরার সুযোগ পাবেন এবং তারা দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে খাটো করতে কোনো বিরাষ্ট্রীয় উপাদানকে অনুমোদন দেবেন না।
বিকল্প একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তা হলো, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে একরকম হিস্টেরিয়া ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে টিভি চ্যানেলগুলো। এটা হলো টিভির উপসংহার।
২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বইয়ে ভয়াবহ রক্তপাত হয়। এরপরের বছরে ২০০৯ সালে ভারতে জাতীয় নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি আঙ্গুলও না তুলে বিজয়ী হয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। পক্ষান্তরে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে শার্ম আল শেখ সম্মেলনে গিয়েছিলেন। তার দল শান্তিচুক্তি করেছিল এবং তা নিয়ে তার দল উল্লাস করেছিল এটা আরেকটি বিষয়।
অন্যদিকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী কারগিল যুদ্ধ জিতেছিলেন। কিন্তু তার পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার ভোটের শতকরা হার কিন্তু কমে গিয়েছিল। ওটা হয়েছিল টিভির খবরের কারণে নয়। এটাই বাস্তবতা।
(লেখক নয়া দিল্লিতে পাকিস্তানি পত্রিকা ডন-এর প্রতিনিধি। তার এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দ্য স্ট্রেইটস টাইমসে। সেখান থেকে অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.