২৫,০০০ অবৈধ গুদাম কারখানা পুরান ঢাকায়: অভিযানে বাধা, মেয়র বললেন ছাড় নয়

ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ কেমিক্যাল কারখানা ও গুদামে রাজধানীর পুরান ঢাকা যেন এক গুপ্ত নরকুণ্ড। নিমতলী ও চুড়িহাট্টা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অবৈধ এসব কারখানা-গুদাম কতোটা সর্বনাশা রূপ নিতে পারে মুহূর্তে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে অন্তত ২৫ হাজার অবৈধ কারখানা ও গুদাম রয়েছে পুরান ঢাকায়। যেখানে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ মজুত রাখা হয়। যা  যে কোনো মুহূর্তে বিপদের কারণ হতে পারে।
সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মোট ৯৪৪টি কেমিক্যাল কারখানা রয়েছে যার মধ্যে ৭৭ টি বৈধ। নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর ২০১৩ সাল থেকে এসব কারখানার কোনো নবায়ন করেনি সিটি করপোরেশন। ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ এসব কারখানা পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সসহ সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আর অন্যদিকে পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বলছে, পুরান ঢাকায় প্রায় ২৫ হাজার স্থাপনা রয়েছে।
এসব স্থাপনায় কেমিক্যাল, প্লাস্টিক কারখানা, গুদাম ও অন্যান্য বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ ভরপুর রয়েছে।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ এসব দাহ্য পদার্থের কারখানা গত নয়বছর ধরে নানা উদ্যোগ নিয়েও সরানো সম্ভব হয়নি। চুড়িহাট্টার ভয়াল অগ্নিকাণ্ডের পর বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে অভিযান চালাতে গিয়ে বাধার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন মানবজমিনকে বলেন,  নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে আমরা নানাভাবে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। কাজ করবে সরকার তারা যদি না করে তাহলে আমাদের কী করার আছে। গত ক’বছর ধরে সরকার শুধু পরিকল্পনাই করছে আর বলছে এটা করবে ওটা করবে। বাস্তবে কিছুই করেনি। তিনি বলেন, পুরান ঢাকার কারখানার মালিকরা অন্যত্র যেতে চান না। না যাওয়ার পেছনে হয়তো অনেক কারণ থাকতে পারে। তারা সরকারের সঙ্গে লবিং করে সময় বিলম্ব করেছেন। ফলে আরো একটি দুর্ঘটনা ঘটল। আইন ও সরকারের নিয়মনীতির প্রয়োগ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, খারাপ মানুষ খারাপ কাজ করবেই। তবে আইনের মাধ্যমে তাদেরকে একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
গতকাল পুরান ঢাকার চকবাজারের জয়নাগ রোডে প্লাস্টিক কারখানায় অভিযান চালাতে গিয়ে বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যদেরকে। ওই রোডের একটি বাসায় টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যরা কেমিক্যালের গোডাউন খুঁজে পান। তখন ওই ভবনের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় ব্যবসায়ীরা জড়ো হয়ে বাধা প্রদান করে। এতে করে টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যরা তোপের মুখে পড়ে অভিযান স্থগিত করে মেয়রকে বিষয়টি জানান। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি এসে স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মিটমাট করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, কেমিক্যাল কারখানায় অভিযান নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক কথা ছড়ানো হয়েছিল। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছে, অনুুধাবন করেছেন। এখন তারা আমাদেরকে সহযোগিতা করছেন। যে ভুল বোঝাবুঝি বা বিভ্রান্তি ছিল সেটা এখন আর নাই।
মেয়র বলেন, মানুষের জান মালের নিরাপত্তার জন্য আমরা কেমিক্যাল কারখানাগুলো অন্যত্র সরাতে চাচ্ছি। কিন্তু এক শ্রেণির লোক এটাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যবসায়ীদের ভুল বুঝানোর চেষ্টা করেছিল। প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হবে বলেও গুজব ছড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা যেসব ভবনে কেমিক্যালের অস্তিত্ব পাচ্ছি সেসব বাসাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে ধরে নিচ্ছি। যদি কোনো কারণে এসব ভবনে বিস্ফোরণ হয়  সেজন্য নিরাপত্তার স্বার্থেই বিদ্যুৎ, গ্যাস পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। যাতে করে আশপাশের এলাকায় আগুন না ছড়ায়। মেয়র বলেন, আমাদের অভিযান চলবে। পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্যই আমাদের এ অভিযান। আমরা চাই না আরেকটি নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো ঘটনা।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন মানবজমিনকে বলেন, চুড়িহাট্টায় প্রথমে সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে পরে পারফিউম কেমিক্যাল থেকে ছড়িয়ে পড়ে। দায়টা কেমিক্যালের ওপর দিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের প্লাস্টিক কারখানার সঙ্গে আগুনের কোনো সম্পর্ক নেই। প্লাস্টিক কারাখানায় আগুন লাগলেও সেটা ছড়াবে না। তারপরও আমাদেরকে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। মেয়রের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি আমাদেরকে বলেছেন, শুধুমাত্র কেমিক্যালের ফ্যাক্টরি ও গুদাম যেসব ভবনে আছে সেসব ভবনের ইউটিলিটি সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হবে। কোনো বাড়ির ইউটিলিটি সার্ভিস বন্ধ করা হবে না। তিনি বলেন, প্লাস্টিক ব্যবসায়ীদের ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোন রয়েছে। এই ব্যবসার সঙ্গে একহাজার ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা জড়িত। মালামাল ও কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য আমাদেরকে সময় ও স্থান দেয়া হোক।
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল, প্লাস্টিক ও দাহ্য পদার্থের কারখানা অপসারণে টাস্কফোর্সের অভিযান শুরু হয়েছে গত বৃস্পতিবার থেকে। প্রথম দিনের অভিযানে  ২৪ নং ওয়ার্ডসহ শহীদ নগর ও  ২৯ নং ওয়ার্ড ও ইসলামবাগ এলাকার ২১টি বাড়িতে কেমিক্যাল ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গতকাল দ্বিতীয় দিনে টাস্কফোর্সের একটি টিম শহীদ নগর ও বউবাজারের আটটি কারখানার কেমিক্যালের উপস্থিতি পেয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অভিযানের বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুবর্ণা শিরিন বলেন, আমরা শহীদ নগর ও বউবাজার এলাকায় ঘুরে আটটি কারখানার ইউটিলিটি সার্ভিস বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। এসব কারখানায় অতি দাহ্য পদার্থ ছিল।
এদিকে গতকাল সরজমিন রাজধানীর চকবাজার, আরমানিটোলা, নিমতলী, হাজী আজগর লেন, জয়নাগ রোড, মৌলভীবাজার, রহমতগঞ্জ, মিটফোর্ড, মাজেদ সরদার রোড ঘুরে দেখা গেছে এসব এলাকার বেশির ভাগ বাড়িতেই কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব কারখানা ও গুদামে সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, থিনার, গ্লিসারিন, সোডিয়াম থায়োসালফেটসহ আরো অনেক ভয়ঙ্কর দাহ্য পদার্থ রয়েছে। শুধুমাত্র একটু আগুনের ছোঁয়া পেলেই এসব দাহ্য পদার্থ থেকে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, হাজারীবাগ, শ্যামপুর, লালবাগ কামরাঙ্গীরচর, চকবাজার, বংশাল এলাকায় সবচেয়ে বেশি কেমিক্যালের কারখানা। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে মতিঝিল, পল্টন, নিউমার্কেট, তেজগাঁও, মিরপুর, উত্তরা, পল্লবী, কাফরুল, শাহ্‌ আলী থানা এলাকায় দাহ্য পদার্থের গোডাউন রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, তাদের হিসাবে ৮৬৭টি অবৈধ কেমিক্যাল গুদামের মধ্যে ৩৭১টির অবস্থান পুরান ঢাকার সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি থানায়। তেজগাঁও, গুলশান ও বনানী এলাকায় রয়েছে ৬৮টি, কামরাঙ্গীরচরে ৮৭টি ও রমনা থানা এলাকায় ৬৬টি।

No comments

Powered by Blogger.