এ কেমন বিদায় by শুভ্র দেব

বড় ভাইকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে এসেছিলেন ডালিম। সঙ্গে তার একমাত্র  বোনের স্বামী মোবারক। সোমবার ছিল ডালিমের ভাই রুবেলের ফ্লাইট। তাই রোববার বিকালেই নরসিংদী থেকে তারা এসে উত্তরার একটি হোটেলে উঠেন। রুবেলকে হোটেলে রেখে ডালিম ও মোবারক সন্ধ্যায় ঘুরতে বেরিয়েছিলেন বিমানবন্দর এলাকায়। সেই ঘোরাই যে তাদের জীবনের শেষ ঘোরা তা কে জানতো? বেপরোয়া এক ট্রাকের চাপায় বিমানবন্দরের প্রবেশ পথে প্রাণ হারান তারা। স্বজনকে বিদায় জানাতে এসে তারা নিজেরাই ধরলেন চির বিদায়ের পথ। নিজের বিদায়ে এসে যারা প্রাণ হারালেন তাদের শেষ বিদায়ে  না থাকার কষ্ট নিয়েই সোমবার সৌদি আরব গেছেন রুবেল।
তার একমাত্র বোনের সঙ্গে মোবারকের বিয়ে হয় ঘটনার মাত্র ১৮ দিন আগে। মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক এই ঘটনাটি ঘটেছে রোববার রাতে ঢাকা বিমানবন্দরের পুলিশ চেকপোস্টের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে থাকেন নরসিংদীর রায়পুরার আবদুল মান্নান (২৩)। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো।
২৫ বছর বয়সী বড় ভাই রুবেলকে সৌদি আরবে নেয়ার জন্য একটি ভিসার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই মোতাবেক গতকাল দুপুরে ছিল তার ফ্লাইট। রুবেলকে বিদায় দিতে আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন তার ছোট ভাই ডালিম (২০) ও তার একমাত্র বোনের স্বামী মোবারক হোসেন (৩০)। পরের দিন ফ্লাইট হওয়াতে তারা উত্তরার একটি আবাসিক হোটেলে উঠেন। রাতের বেলা রুবেলকে হোটেলে রেখে বাইরে ঘুরতে বের হন শ্যালক ও বোন ভগ্নিপতি। ঢাকা বিমানবন্দরের বাইরে তারা ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করেন। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে তারা বাসায় ফেরার উদ্দেশে রওনা দিয়ে আসেন বিমানবন্দরের প্রবেশ পথের আর্মড পুলিশের তল্লাশি চৌকির কাছে। ঠিক তখনই রডবোঝাই একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের দু’জনকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলেই দু’জনের মৃত্যু হয়। নিহত ডালিম রায়পুরার আনোয়ারাবাদের আতর মিয়া ও সুফিয়া বেগমের ছেলে। আর মোবারক রায়পুরার সামুদ নগরের মৃত আবদুল খালেক ও হেলেনা বেগম দম্পতির ছেলে। 
নিহত ডালিমের মামা আনোয়ার হোসেন মানবজমিনকে বলেন, তার তিন ভাগ্নে ও এক ভাগ্নি। মাত্র ১৮ দিন আগে ভাগ্নি শাবনুরের বিয়ে হয়েছিল মোবারকের সঙ্গে। ভাইকে বিদায় দিতে সে ও তার স্বামী বাবার বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু এক ভাইকে বিদায় দিতে এসে আরেক ভাই ও নিজের স্বামীকেই চিরবিদায় দিতে হয়েছে তার। আনোয়ার বলেন, আমার ভাগ্নির মেহেদির রং এখনো মুছেনি। একমাত্র ভাগ্নি আমাদের। তার মা-বাবা ও ভাইদের অনেক আদরের ছিল। পারিবারিকভাবেই জাঁকজমক আয়োজনে বিয়ে দেয়া হয়েছিল তার। তার স্বামীর বাড়ি ও বাপের বাড়িতে এখনো বিয়ের আমেজ রয়ে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল। আমার বোনের বাড়িতে এখন শোকের মাতম চলছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে। আমার বোনের বড় আদরের ছেলে ছিল ডালিম। ছেলের শোকে তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। আর ভাগ্নি তার স্বামী ও স্বামীর সংসারকে বুঝে ওঠার আগেই স্বামীহারা হয়ে গেল। এদিকে রোববার রাতে বিমানবন্দর থানায় তৈরি হয়েছিল এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ। ভাই ও ভগ্নিপতি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন এটা ভাবতেই পারছিলেন না সৌদিগামী যাত্রী রুবেল। তারা কান্নায় অনেকের চোখের কোণে এসেছিল জল। একদিকে আদরের বোনের স্বামী অন্যদিকে ছোট ভাই। চোখেমুখে অনেকটা বিষণ্নতার ছাপ, বুকভরা কষ্ট আর চোখে জল নিয়ে রুবেল বলেন,  আমি এখন কি করে বিদেশে যাব। আমি সেখানে গিয়ে থাকতে পারবো না।
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমাকে হোটেলে রেখে তারা ঘুরতে বের হয়েছিলেন। আমি একা একা হোটেলে বসে তাদের অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তারা যে না ফেরার দেশে চলে গেছেন এটা আমি ভাবতে পারছি না। রুবেলকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এ সময় পুলিশ সদস্যরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।  আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধে ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই রুবেল গতকাল দুপুর আড়াইটায় সৌদি আরবের উদ্দেশে পাড়ি জমান। বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক শ্রীদাম চন্দ্র রায় মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ওই ট্রাকের চালক ও তার সহকারীকে আটক করা হয়েছে। নিহতের স্বজনরা সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আসামিরা বর্তমানে কারাগারে আছে।

No comments

Powered by Blogger.