মাহদি হত্যা: কাফনের কাপড় পরে শাবি শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ by ওয়েছ খছরু ও আরাফ আহমদ

মাহদি হত্যা ঘটনায় উত্তাল সিলেট। প্রতিবাদে কাফনের কাপড় পরে রাজপথে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চেয়েছেন জীবনের নিরাপত্তা। গতকাল সকাল থেকে বিক্ষোভমুখর ছিল সিলেট মহানগর। পুলিশ জানিয়েছে, মাহদির খুনের ঘটনায় জড়িত ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ অভিযান জোরদার করেছে। শিগগিরই পুলিশ খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। মাহদির পুরো নাম মাহিদ আল সালাম। বাড়ি সিলেটের মদিনা মার্কেট এলাকায়। শান্তশিষ্ট স্বভাবের মাহদি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক ছাত্র। সে অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেছে। ক্যাম্পাসের খুবই প্রিয় মুখ ছিল মাহদি। শিক্ষাজীবন শেষ করলেও অনুজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় প্রায়ই ছুটে যেতো ক্যাম্পাসে। তার এই মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে শাবি ক্যাম্পাসে। ছাত্র-শিক্ষক সবাই শোকাহত। সিলেটবাসীও শোকে মুহ্যমান। রোববার রাত ১টার দিকে মাহদি ঢাকায় যাওয়ার জন্য নিজ বাসা থেকে বের হয়। ঢাকায় একটি ব্যাংকে সে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিলো। রাত আড়াইটার দিকে সিলেট নগরীর বাসস্ট্যান্ড এলাকার কদমতলীতে মাহদির রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে এক রিকশাচালক। তখনও জীবিত ছিল মাহদি। ওই রিকশাচালক পুলিশের কাছে মাহদিকে তুলে দেয়। রাত সাড়ে ৩টার দিকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ছিনতাইকারীরা মাহদিকে ছুরিকাঘাত করে তার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। মাহদির ঊরুতে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করে। এদিকে মাহদি খুনের ঘটনায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘটনার পরদিন সোমবার মাহদির লাশ দেখতে ভিড় জমান অনুজ শিক্ষার্থীরা। ছুটে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরাও। গতকাল সকাল থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে সিলেট। ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে মানববন্ধন করেন। পরে তারা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে আসে। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারের পার্শ্ববর্তী চৌহাট্টা এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বসে মাহিদের খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকে। চৌহাট্টা এলাকায় সড়ক অবরোধ করায় বন্দরবাজার-আম্বরখানা ও কুমারপাড়া-মেডিকেল সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। অবরোধের এক পর্যায়ে কাপনের কাপড় পরে মাহদির সহপাঠীরা রাস্তায় শুয়ে পড়েন। এই কর্মসূচিতে যোগ দেন সিলেটের রাজনৈতিক নেতারাও। ছুটে যান সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম সহ সিনিয়র নেতারা। চৌহাট্টার ট্রাফিক পয়েন্টে এ সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি বলেন, মাহদি দেশের ভবিষ্যৎ ছিল। তার কাছ থেকে জাতি অনেক কিছু পেতো। কিন্তু ছিনতাইকারীরা তার প্রাণ কেড়ে নিলো। এই আন্দোলন শুধু শাবি শিক্ষার্থীদেরই নয়, গোটা সিলেটবাসীরও। সবাই এ ঘটনায় মর্মাহত। তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, দ্রুত মাহদির খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য তিনি পুলিশ প্রশাসনকে আরো বেশি সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। এদিকে বেলা দুইটার দিকে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে যান শিক্ষার্থীরা। তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করতে থাকেন। ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন সিলেটের জেলা প্রশাসক নুমেরী জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম, সিলেট মহানগর পুলিশের ডিসি (উত্তর) ফয়সল মাহমুদ। শিক্ষার্থীরা এ সময় মাইকে মাহদির খুনিদের গ্রেপ্তার না করায় পুলিশের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়েন। সাবেক শিক্ষার্থী কাশমির রেজা ছাড়াও এ সময় বক্তব্য রাখেন শাবি’র সহকারী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন। তারা বলেন, এ ঘটনায় খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত। ভোরে বাইরে থেকে যেসব শিক্ষার্থী সিলেটে আসেন তারা প্রায় সময়ই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনকে বার বার অবগত করা হলেও পুলিশ কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। শেষ মুহূর্তে খুন হতে হলো মাহদিকে। সিলেটের জেলা প্রশাসক নুমেরি জামান এ সময় জানান, দ্রুততম সময়ের মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন সক্রিয়। আমরা আশা করি পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করবে। সিলেটে আর যাতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়টি নিয়ে সবাই সতর্ক থাকবে বলে জানান তিনি। শিক্ষার্থীরা এ সময় জেলা প্রশাসকের কাছে তাদের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি তুলে দেন। স্মারকলিপিতে মাহদির খুনিদের গ্রেপ্তার ও শাবি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি জানানো হয়। বক্তব্য দিতে গিয়ে ছাত্রদের ক্ষোভের মুখে পড়েন সিলেট মহানগর পুলিশের ডিসি উত্তর ফয়সল মাহমুদ। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদেরই স্বজন। তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া উচিত নয়। মাহদির খুনিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ অভিযানে রয়েছে। যারা মাহদিকে খুন করেছে খুব দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে তিনি শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন। এছাড়া দুপুর ২টার দিকে মাহিদের লাশ এম্বুলেন্সে করে শাবিতে আনা হয়। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে রাখার পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় করে। এসময় ক্যাম্পাসে শোকের ছায়া নেমে আসে। এদিকে বিকালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধন থেকে মাহদির খুনিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানান বক্তারা।

No comments

Powered by Blogger.