দাসত্ব প্রথা আজও চালু রয়েছে by তৈমূর আলম খন্দকার

নৈতিকতা, আদর্শ, বিবেক, মানবতা সবই যেন নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুর পেছনে আইনের দোহাই। ‘প্রকৃতি’ মানুষকে যে অধিকার দিয়েছে, সে অধিকার প্রাপ্তিতেও বাধা; সাংবিধানিক অধিকার প্রাপ্তিতেও বাধা। এ ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার ‘আইন’। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য যুগে যুগে সংস্কারকের অবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু বাহুবল, তলোয়ারের তেজ এবং বুদ্ধির কূটকৌশলে মানুষ মানুষকে দাস বানিয়েছে, গরু ছাগলের হাটের মতো মানুষ কেনা বেচার জন্য ‘দাস বাজার’ বসতো এবং সেটাও চলেছে প্রায় যুগের পর যুগ মানুষ মানুষকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সময় থেকে শাসন করেছে ‘শক্তি’ দিয়ে, এখনো শাসন-শোষণ করছে ‘শক্তি’ ব্যবহার করেই। শক্তির শুরু ‘বাহুবল’ দিয়ে, অতপর অস্ত্র। এখন চলছে ‘কলমে’ অর্থাৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। পানি নিচের দিকে গড়ায় এবং বাঘ-সিংহ মাংসভোজী, হাতি-হরিণ তৃণভোজী প্রভৃতি প্রাকৃতিক নিয়ম, কিন্তু আইন নয়। আইন বলতে কী বুঝায় তা নিয়ে বহু বই প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন উচ্চ আদালত নানা মতামত দিয়েছেন। কিন্তু সবাই একটি বিষয়ে একমত, যা ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান রয়েছে এবং সে বিধান কার্যকর করার জন্য কোনো শক্তি (Authority) রয়েছে, সেটাই ‘আইন’। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট Sant Ram Versus Labh Singh (AIR 1965 SC 314) মোকদ্দমায় একটি রায়ে আইনের ব্যাখ্যায় LAWS IN FORCE কথাটি সংযোজন করেছেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘আইন’ সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছেন, আমার ধারণা- সেটাই সঠিক। কারণ যে নদীতে চর পড়ে, অর্থাৎ নদীতে নাব্য থাকে না, কালের স্রোতে সে নদী ধু ধু বালুর চরে পরিণত হয়। ‘আইন’ নিজে গতি হারিয়ে ফেলে যদি তা কার্যকর না থাকে। যে যত কথাই বলুন না কেন, একমাত্র ধর্মীয় অনুশাসন ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রজাদের (নাগরিক) নিয়ন্ত্রণসহ সব কিছুর মূলেই রয়েছে শক্তি অর্থাৎ MIGHT IS RIGHT। শক্তির বলে রাজ্য জয় করে রাজা যে নিয়ম-পদ্ধতি নির্ধারণ করতেন সেটাই সে সময়ের আইন। এক হাজার ৫০০ বছর আগে চিন্তা চেতনায় বিপ্লব ঘটিয়ে শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের পর আল্লাহ প্রদত্ত কুরআনি আইন কার্যকর করা শুরু হয়। ঘটনা প্রবাহে পরবর্তীকালে মুসলিম শাসক কুরআনি আইনের কোথাও কোথাও ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজস্ব মতবাদ চালু করেছেন শুধু নিজেদের ভোগ-বিলাসিতার জন্য। হজরত মুহাম্মদ সা: বিদায় হজের ভাষণটি অনন্য দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য এবং স্পষ্টভাবেই ওই ভাষণে তিনি দাসপ্রথা বাতিলে উদ্বুদ্ধ করলেও বিলাসী মুসলিম শাসকেরা দাস প্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু না রাখলেও তাদের সময়েও এই প্রথা কার্যকর ছিল। দাস প্রথা বর্তমান বিশ্বেও চালু এখনো রয়েছে। তবে অবস্থা ও পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তথা লাখ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এক একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের নেতাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের। সংবিধানে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হলেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার জন্য নাগরিক অধিকার হরণ করার উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা অনুযায়ী নিত্যনতুন আইন পাস করা হয় তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার দাপটে ছাপা অক্ষরের সংবিধান LAWS IN FORCE-এর কাছে স্তব্ধ ও অসহায় হয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত মতে, প্রতিটি স্বাধীন দেশের সংবিধানই সে দেশের সর্বোচ্চ আইন হলেও সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চয়তা প্রদান করতে সে রাষ্ট্রের সংবিধান বিশেষ করে, বাংলাদেশের সংবিধান ব্যর্থ হচ্ছে। ০১. আইন কি জনগণের কল্যাণের জন্য প্রণীত? ০২. আইন কি ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখার জন্য প্রণীত? এ দুটো প্রশ্নে যদি গণভোট দেয়া হয়, তবে গণমানুষের রায় কী হবে? গণতন্ত্রের ঘাড়ে চেপে ক্ষমতায় বসে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে নিত্যনতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়ে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করেছিল।
সে একই পার্লামেন্ট ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষসহ তৎকালীন রাজনীতি মোকাবেলার জন্য বিশেষ ক্ষমতা আইন’ ১৯৭৪ প্রণয়ন করেছে, যা কালো আইন হিসেবে হলেও এখনো চালু আছে। বিরোধী রাজনীতিকে দমনের জন্য বর্তমান সরকার গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশব্যাপী প্রতিটি থানায় ব্যাপকহারে ওই আইনে মামলা করেছে, প্রতিটি মামলার বাদি পুলিশ অফিসার। নিজ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য ছলে-বলে-কৌশলে অনেক ক্ষমতাসীন অহরহ অনেক আইন করে যাচ্ছেন, যা দ্বারা মানুষ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা এ ধরনের আইন পাশ করানোর বুদ্ধি, পরামর্শ দিচ্ছেন এবং সহযোগিতা করছেন, তারা গোলামির (দাস প্রথা) বশবর্তী হয়েই এগুলো করছেন। দাস প্রথা এখনো চালু আছে। কোথাও স্বনামে, আবার কোথাও বেনামে। সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’। কিন্তু অন্যান্য রাষ্ট্রের মতোই বাংলাদেশে জুয়া ও গণিকাবৃত্তি চালু আছে। তা বন্ধের জন্য রাষ্ট্র বা সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। গণিকা পেশায়ও নারী কেনা-বেচা হয়। সেখানে গণিকার স্বাধীন কোনো চিন্তা করার অধিকার থাকে না বরং ক্রেতার ইচ্ছা অনুযায়ীই গণিকাকে বিলীন হতে হয়। অভাব-অনটন, সামাজিকভাবে নিগৃহীত মহিলা, যারা যৌনদাসীর ভূমিকা পালন করেন; তারাও সমাজব্যবস্থার কারণে দাসী। তারা আধুনিক বিত্তশালী পতিতাদের মতো মহানগরীতে বাড়ি-গাড়ি করতে পারেন না বিধায় গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে বেড়ান। যেখানে চিন্তা-চেতনার স্বাধীনতা নেই, নির্বিচারে শুধু হুকুম পালন করতে হয় শুধু কোনো শক্তির মনোরঞ্জনের জন্য, তা-ই দাসত্ব। চাকরি ও দাসত্ব এক কথা নয়। জনগণের অর্থে লালিত অনেক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্মকর্তারা জনগণের অধিকার যখন হরণ করেন; তখন তারা বলেন, ‘ওপরের নির্দেশে করছি’। ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের উচ্চ আদালত এ সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে যে, Superior illegal order is no order অর্থাৎ উপরস্থ কর্মকর্তার অবৈধ আদেশ বৈধ বলে গণ্য হবে না।’ এরপরও পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিরোধী দলসহ সাধারণ মানুষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করছে কিংবা তাদের অধিকার হরণ করছে একই কথা বলে যে, ‘ওপরের নির্দেশ’। ওপরের বেআইনি নির্দেশ পালন করাই এক ধরনের ‘দাসত্ব’। কারণ মানুষের বিবেক যখন বিক্রি হয়ে যায়, তখন মানুষ তার নিজস্ব চালিকাশক্তি হারিয়ে ফেলে দাসে পরিণত হয়। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে চলছে একই অবস্থা।
লেখক : বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.