তাহলে সরকার কী করবে? by ড. আবদুল লতিফ মাসুম

আমরা যখনই ‘সরকার’ শব্দটি উচ্চারণ করি, তখন রাষ্ট্রের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনাব্যবস্থাকেই বুঝি। ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এতই ব্যাপক যে, তা পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়, তাদেরকে সফলতা ও ব্যর্থতার জন্য দায়ী হতে হয়। ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর গুণপনা একটি সংসার, একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে দিতে পারে। অনুরূপভাবে ব্যক্তির অলসতা, অসততা, অকর্মণ্যতা, অযোগ্যতা, অনভিজ্ঞতা কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য সর্বনাশের কারণ হতে পারে।
রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনাকেও আমরা গুণ আর দোষ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি। এভাবে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দল বা গোষ্ঠী পৃথিবীর ইতিহাসে ভালোমন্দের জন্য খ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে আছে। জওয়াহের লাল নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন শপথ গ্রহণ করেন, তখন মহাত্মা গান্ধী তাকে এই বলে আশীর্বাদ করেছিলেন, ‘তুমি অশোক এবং উমরের মতো সুশাসক হও।’ তাহলে বোঝা যায় মানুষের মঙ্গল নিশ্চিত করাই শাসকদের কর্তব্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে, ‘সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক সুখ নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য।’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি একটি সরকার দিয়ে শাসিত। সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সময়ন্তরে একটি গণতান্ত্রিক প্রথা পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরকার সংবিধানের ওই লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করবে- এটাই প্রত্যাশিত। যেকোনো সরকার বা রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তি শপথগ্রহণ করে তখন সে প্রতিজ্ঞা করে- ‘অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হইয়া কোনো কাজ করিব না।’ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও শপথের অঙ্গীকার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের কর্ণধারদের জন্য করণীয় নির্ধারণ করেছে। সরকারের করণীয় নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। একজন প্রধানমন্ত্রী যখন শপথগ্রহণ করেন, তখন এসব দায়-দায়িত্ব তিনি এবং তার সরকারের ওপর সমর্পিত হয়। বিগত ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফর সম্পর্কে জানাতে আহূত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত এ রকম কিছু বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের অবতারণা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার সাজা, তাকে ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন মানুষের অধিকার। তার গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার, সে প্রয়োগ করবে। এখন তাকে (বেগম খালেদা জিয়া) ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। তিনি আরো বলেন, ‘রায়টাতো আমি দেইনি। রায়টা দিয়েছেন কোর্ট। আর মামলা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দুদক।’ খালেদা জিয়ার সাজা বা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে তার করণীয় নেই জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ যদি না করে কারো কিছু করার নাই।’ প্রধানমন্ত্রী আরো স্পষ্ট করে বলেন, ‘আর যদি বলেন আমি শাস্তি দিয়েছি, আমি তুলে নেবো- তাতেও আমি পারব না। এটা কোর্ট দিয়েছে, মামলা করেছে দুদক।’
নির্বাচন করা দলগুলোর নিজস্ব ব্যাপার মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোন দল নির্বাচন করবে আর কোন দল করবে না এটা সম্পূর্ণ তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু নির্বাচন সময় মতো হবে। জনগণও ভোট দেবে।’ সংবাদ সম্মেলনের একপর্যায়ে চলতি এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি উত্থাপিত হয়। প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রী কী নিজে প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে গেছেন বা সচিব গেছেন বা যারা শিক্ষক তারা কি গেছেন?... এটা নিয়ে একবার সুর তুলে একবার মন্ত্রীকে দায়ী, একবার সচিবকে দায়ী, একবার সরকারকে দায়ী করা হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস সব সময় যুগ যুগ ধরে চলে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কখনো প্রচারিত হয় কখনো হয় না।’ পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা বা ২০ মিনিট আগে প্রশ্ন দেখার পর ওই প্রশ্নানুযায়ী বই খুলে সেই প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে তা স্মরণ করে খাতায় লেখার মতো মেধাবী (ট্যালেন্টেড) ছাত্র আছে কিনা, তা প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রশ্নফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিতে সাংবাদিকদের সহায়তা চান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিক, আপনাদের কাছে অনুরোধ করি, আপনারা দয়া করে অন্তত একজনকে বের করে দেন, সাথে সাথে শাস্তি দেবো। কারণ, আমরাও চাই না এভাবে প্রশ্নফাঁস হোক বা এই বদনামটা হোক।’ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ২০ মিনিট, আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র হলে চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তখন বিতরণ করার জন্য প্রতিটি কক্ষে দেয়া হয়... এখন সবার হাতে মোবাইল, কেউ ছবি তুলে নিতে পারে। এ ছাড়াও নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ওই সংবাদ সম্মেলনে। এ দুটো বিষয় নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সম্ভবত এই কারণে- যে একটি বিষয় প্রকারান্তরে নির্বাচনকেন্দ্রিক, অপরটি শিক্ষা সংবেদনশীল। আমরা সবাই জানি বাংলাদেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রচলিত। আর রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা হচ্ছে সংসদীয় নির্বাচনের অপরিহার্য অংশ। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেননি। নিশ্চিত করেছেন যে আগামী ডিসেম্বরে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচন যেমন আইনে, সমাজে এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় তেমনি একটি খেলা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সম্ভব নয়। অসম্ভবকে সম্ভব করে যখন এ ধরনের খেলা হয় তখন তাকে বলা হয় পাতানো খেলা। এরকম ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচনটি হল তা যেকোনো বিবেচনায় ছিল- প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। খোলা মাঠে যারা গোল দিয়ে জিততে যায় সে বিজয় কোনো বিজয় নয়। পৃথিবীর তাবৎ সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য রীতিনীতি, প্রথা ও পদ্ধতি- কোথাও ওই নির্বাচনের নমুনা পাওয়া যাবে না। আগামী সংসদীয় নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। এ দেশের একজন নাবালকও বোঝে যে, খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে নির্বাসন দিলে কার লাভ? বিচারের রায় নিয়ে প্রশ্ন করা সঙ্গত নয়। কিন্তু সাধারণ ধারণা কেন বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে- সে প্রশ্নও স্বাভাবিকভাবে উত্থাপন করা যায়। স্থান কাল পাত্র বলে যে ধারণাটি আছে তা কিভাবে অগ্রহ্য করা যাবে? সংসদীয় রীতিনীতি অনুযায়ী সংসদীয় বিরোধী দলকে সরকারের অঙ্গ মনে করা হয়। সে ধারণানুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা সংসদীয় সরকারেরই দায়িত্ব। ইলেকশন কমিশন নির্বাচনকালীন সময়ে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। সরকার নির্বাচন পর্যন্ত দলকে এগিয়ে দেবে- এটাই সংসদীয় সংস্কৃতি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে ছলে বলে কলে কৌশলে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ বিএনপির ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত না করে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ সবার জন্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে সংসদীয় নির্বাচনটি করেছিলেন সেটি ছিল এ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ। অথচ সে সময় নির্বাচনের জন্য কোনো আন্দোলন ও আবেদন ছিল না। এটা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, আমরা বাংলাদেশে বসবাস করি। আর বাংলাদেশ তৃতীয় বিশে^র একটি মধ্যম আয়ের দিকে ধাবিত উন্নয়নশীল দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়কালে কোন কোন ক্ষেত্রে দেশের উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু কাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সাথে গণতন্ত্রের উন্নয়ন না ঘটে বরং অনুন্নয়ন ঘটেছে- এটা বিদ্ব্যজনদের মন্তব্য। বাংলাদেশে রাজনৈতিক উন্নয়ন যে উন্নত দেশের মতো নয় সে কথা সবাই স্বীকার করেন। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বের মানদণ্ডে যদি বিচার করা হয় তাহলে রাজনৈতিক হিংসা প্রতিহিংসা, অসহিঞ্চুতা, অরাজকতা ও ষড়যন্ত্র রাজনীতিরই অংশ।
সুতরাং খালেদা জিয়ার মামলা, কারাবাস এবং বিএনপির প্রতি দমনপীড়ন- এসব থেকে সরকার তার স্বাতন্ত্র্যের কথা বলে পার পাবে না। একই মামলায় দুই আমলে দুই ধরনের রায় দেয়ার নজির বাংলাদেশে রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া যদি ন্যায়বিচার না পান তাহলে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। যে দেশে ভিন্ন মত পোষণের জন্য দেশত্যাগ করতে হয়, সে দেশে কী না হতে পারে? এবার আসা যাক প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব। সে দায়িত্ব সুসম্পন্ন করার জন্য যারা দায়িত্বশীল তারা যদি দায়িত্ব পালনে অযোগ্য, অকর্মণ্য ও অনভিজ্ঞ প্রমাণিত হন তাহলে তারা কি দায়িত্বহীনতার জন্য অভিযুক্ত হবেন না? পৃথিবীর সর্বত্র নীতিগত ব্যর্থতার কারণে উচ্চ মর্যাদাধারীদের অনেকের পদত্যাগের উদাহরণ রয়েছে। পদত্যাগ করা না করা ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট। সংসদীয় রীতিনীতিতে সামষ্টিক দায়িত্বের কথা আছে। সুতরাং প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারেও কি আমাদের তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন দেখতে হবে? এর আগেও নাগরিক সাধারণ সোনার মেডেলে ভেজালের পর তার পক্ষে সাফাই মন্তব্য শুনেছে। গডফাদারদের আনুকূল্যে মন্তব্য শুনেছে। এ দেশের দুর্নীতিবাজ বলে অভিযুক্ত ব্যক্তি গুড ক্যারেক্টারের সার্টিফিকেট পেয়েছেন। নির্বাচন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অবাধ লুটপাট, সন্ত্রাস, দুর্নীতি- কোনো কিছুরই বিরুদ্ধে সরকার যদি কোনো পদক্ষেপই নিতে না পারে তাহলে তারা কি করবে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ফেইলড স্টেট বা ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে একটি টার্ম রয়েছে। ব্যর্থ রাষ্ট্র তাকেই বলা হয় যেটি রাষ্ট্র পদবাচ্য অথচ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে যথার্থ কর্তৃত্ব প্রয়োগে ক্ষমতা রাখে না। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করার জন্য বাংলাদেশের শত্রুরা নানা ধরনের ফাঁক ফোকর, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছে। বাংলাদেশ সরকারের কোনো কার্যক্রম ও মন্তব্য ব্যর্থ রাষ্ট্রের অনুগামী হোক এটা আশা করা যায় না। তবে সরকারের দায়-দায়িত্ব নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে তাকে কি ব্যর্থ সরকার বলা যাবে না?
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.