বইমেলায় দৃষ্টিজয়ীদের বই by শওকত আলী রতন

অমর একুশের গ্রন্থমেলায় অসংখ্য বাংলা-ইংরেজি প্রিন্ট বইয়ের স্টলের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে বিশেষভাবে মুদ্রিত স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। মেলায় ব্রেইল স্টল নিয়ে সাধারণ দর্শনার্থীদের রয়েছে নানা কৌতূহল। দৃষ্টিহীনদের হাতের আঙুলের স্পর্শে বই পড়াকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনীর জন্ম। মহৎ একটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ব্রেইল প্রকাশনী। যাদের চোখে আলো নেই, তারা পড়তে জানে এমন কথা একসময়ে অবিশ্বাস্য হলেও এখন সহজেই বিশ্বাসযোগ্য। যাদের চোখের জ্যোতি নেই তারাও পড়তে জানে, তাদেরও পড়ার অধিকার আছে এবং ব্রেইল পদ্ধতির বইয়ের সহজলভ্যতার বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ২০১১ সালে সাতটি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। সেই থেকে নিয়মিত বই প্রকাশ করে আসছে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। প্রতি বছর প্রকাশনা উৎসবসহ ও বিনামূল্যে বই বিতরণ আয়োজন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সব শ্রেণীর পাঠক ও দর্শনার্থীদের কৌতূহল নিয়ে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনীর সামনে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীরা খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে যাচ্ছেন আর কোনো রকম জড়তা কিংবা বিরক্ত না হয়েই সবার সব প্রশ্নের উত্তর সাবলীবভাবে দিয়ে যাচ্ছেন স্পর্শ ব্রেইলের দু’জন কর্মকর্তা শাহীনুল হক জয় ও রিপা তাবাসসুম। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা আজ আর পিছিয়ে নেই বই পড়া থেকে। তারাও গল্প, কবিতা আর উপন্যাসের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়তে পারছে ব্রেইল প্রকাশনার কল্যাণে। নানা প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় থেমে নেই তারাও। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিজয়ীরা।
স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার প্রথম বই ‘ছড়ার তালে মনটা দোলে’ লেখক নাজিয়া জাবীন, যিনি ব্রেইল প্রকাশনার কর্ণধার ও শিশুতোষ লেখক। এ পর্যন্ত স্পর্শ ব্রেইলের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬১। এ বছর মেলায় এসেছে নতুন ১৪টি বই। এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে গল্প, কবিতা, ছড়া ও উপন্যাস। রান্নাবিষয়ক বই ও আরবি আমপারার মতো বইও রয়েছে ব্রেইল প্রকাশনীর। প্রকাশিত সব বই-ই এ দেশের প্রথিতযশা লেখকদের। এ বছর নতুন বইয়ের মধ্যে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের আঁখি এবং আমরা কজন, মোহিত কামালের স্বপ্নডানা, নাজিয়া জাবীনের হাঁসের পায়ে ঘুড়ি, আনিসুল হকের সুন্দরবনের সাদা পাহাড় ও ছোটবেলার কথা। লুৎফর রহমান রিটনের ঝ্যাং এবং প্যাং উল্লেখযোগ্য। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা মেলায় এসে নতুন নতুন সব বইয়ের খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং বই কিনছেন। মেলার ২০তম দিনে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনীর সামনে ছিল উৎসুক দর্শনার্থীদের ভিড়। তারা শুনছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রিপা তাবাসুম ও শাহীনুল হক জয়ের কণ্ঠে অবাক করার মতো শ্রুতিমধুর পাঠ। চোখে না দেখেও যে পড়াশোনা করা যায় তারাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। অনেকেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনছিলেন। শাহীনুল হক জয় বলেন, ব্রেইল প্রকাশনার মাধ্যমে দেশের অনেকেই জানতে পারছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পড়তে পারে। স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার কর্ণধার নাজিয়া জাবীন ব্রেইল সম্পর্কে জানান, ২০০৮ সালে আমার প্রথম শিশুতোষ বই ছড়ায় ছবিতে ছন্দে প্রকাশ হলে সব মহল থেকে ব্যাপক সাড়া পাই। প্রেরণা নামে একটি সংগঠনের কাজ করার সময় দৃষ্টিহীন শিশুরা ব্রেইল পদ্ধতিতে বই পড়তে আগ্রহ প্রকাশ করে। সেই চিন্তাচেতনা মাথায় নিয়ে ২০০৯ সালে ছড়ার তালে মনটা দোলে প্রথম ব্রেইল পদ্ধতিতে বই বের করার পর সবার কাছ থেকে সহযোগিতা পাই। সেই থেকে মাথায় আসে প্রকাশনা করার। ২০১১ শিশুতোষ বই নিয়ে ব্রেইল আত্মপ্রকাশ করলে পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা মেলায় এসে বলেন, ‘আপু আপনারা ভালোবাসা দিবসের কবিতা পড়বেন, তাহলে আমরা কি পড়তে পারব না।’ সবার কথা মাথায় রেখে সব ধরনের বই প্রকাশের উদ্যোগে নিই আমরা। ব্রেইল প্রকাশনীতে সব শ্রেণীর পাঠকের বই পাওয়া যাচ্ছে। আগামীতে আরো নতুন নতুন বই প্রকাশ করা হবে ব্রেইল প্রকাশনা থেকে। তিনি আরো জানান, প্রতি বছর সাভার সিআরপিতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ব্রেইল প্রকাশনার পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয়। ব্রেইল পদ্ধতি যিনি আবিষ্কার করেন তিনি হচ্ছেন- লুই ব্রেইল নামে এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সারা দুনিয়ার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের আলোর পথ দেখিয়েছেন তিনি। পরে ব্রেইল পদ্ধতিকে কম্পিউটারের মাধ্যমে বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাষায় লেখার ব্যবস্থা করেছেন। ফলে অনেক ভাষায় ব্রেইল চালু রয়েছে, যা প্রিন্টারের মাধ্যমে সহজে প্রিন্ট করা হয়ে থাকে। বাংলা ভাষা লেখাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাংলা ব্রেইল করছে। লুই ব্রেইল ১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারি প্যারিসের নিকটবর্তী কুপভেরি নামক একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। যখন তার বয়স মাত্র তিন বছর তখন এক দুর্ঘটনার শিকার হন।
এতে উভয় চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। বাবা বহু চেষ্টা করেও প্রতিকার না পাওয়ায় দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। লুই শিক্ষার্জনের জন্য নতুন পথ অনুভব করল। এতে সে তার সাবেক স্কুলে অপ্রতিবন্ধী তথা স্বাভাবিক শিশুদের সাথে দুই বছর লেখাপড়া করল; কিন্তু শোনা ছাড়া কিছু শিখতে পারল না। ১০ বছর বয়সে প্যারিসের ‘রয়েল ইনস্টিটিউশন ফর ব্লাইন্ড ইউথ’ থেকে বৃত্তি লাভ করায় বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজছিল। বিশ্বের প্রথম প্রতিবন্ধীদের স্কুল প্যারিসে তাকে পাঠানো হয়। সেখানে ১২ বছর পার হলে স্কুল ছেড়ে কোনো ফ্যাক্টরি বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হতো। ১৮২১ সালে চালর্স বারবিয়ার নামে এক সৈনিক লুই ব্রেইলের স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তিনি তার আবিষ্কারের বিষয়ে মতবিনিময় করেন। যার নাম দিয়েছিলেন ‘নাইট রাইটিং’ বা অন্ধকারে লেখা ১২টি ডট বা বিন্দু দিয়ে তৈরি একটি সঙ্কেত, যা কোনো কথা বা শব্দ ব্যতীত সৈনিকেরা যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহার করত। এটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সহায়ক বলে মনে করছিলেন তিনি। এটি সৈনিকের জন্য প্রমাণ করা জটিল ছিল। সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে রাতের আঁধারে এটি ব্যবহৃত হতো। যুবক লুই তা দ্রুত উপলব্ধি করতে পারেন যে, ডট বা ছিদ্র চিহ্নটি উপযুক্ত নয়। তবে একে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী করা সম্ভব। কয়েক মাস নিরলস গবেষণা চালিয়ে ১২ ডটের পরিবর্তে ছয় ডট ব্যবহারের মাধ্যমে একটি আদর্শ সিস্টেম চালু করেন। তিনি কয়েক বছর পর গণিত ও সঙ্গীতের জন্য সঙ্কেত প্রবর্তন করেন। এভাবে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা চালু করেন। ১৮২৭ সালে প্রথম বই প্রকাশ করেন তিনি। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এই পদ্ধতি অনুধাবন করতে পারেননি। স্বাভাবিক মানুষও তা বুঝতে পারেনি তা কিভাবে ব্যবহার বা কাজে লাগাতে হয়। এমনকি একজন প্রধান শিক্ষক একটি স্কুলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু তার পরও গোপনে অনেকে ব্রেইল পদ্ধতি শিখতে থাকে। প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা এর উপকারিতা ও সুফল দেখে আয়ত্ত করা আরম্ভ করে। যখন সবাই বুঝতে সক্ষম হয় যে, এটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও ক্ষীণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের লেখাপড়ার জন্য খুবই প্রয়োজন। তখন ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে ব্রেইল পদ্ধতির প্রসার ঘটতে থাকে। ব্রেইল লেখার জন্য মোটা কাগজ ব্যবহার করতে হয়।

No comments

Powered by Blogger.