ব্যাংক ডাকাতির নতুন পদ্ধতি by আলফাজ আনাম



বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় যে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা নতুন কোনো খবর নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাটের পর খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ চুরি হয়ে গেছে। এরপর আমরা দেখছি, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো সরকারঘনিষ্ঠ বিভিন্ন ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। এ জন্য বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সাধারণ সভায় হঠাৎ করে এমডি এবং চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত থাকতেন। এরপর নতুন পরিচালকদের নাম ঘোষণা করে মালিকানায় পরিবর্তন এসেছে। সরকারের মন্ত্রী ও এমপিরা একাধিক ব্যাংকের মালিক হয়েছেন।
এ দিকে অনেকে নতুন ব্যাংক চালু করে আমানত ‘খেয়ে ফেলেছেন’। এ ধরনের ব্যাংকের মধ্যে একটি হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংক। এই ব্যাংকের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বলেছেন, ব্যাংকের আমানতের চেয়ে ঋণ দেয়ার পরিমাণ বেশি হওয়ায় গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া যাচ্ছে না (যুগান্তর, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭)। অপর দিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংকটি সম্পর্কে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতারাই ব্যাংকটিকে লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে।’ জলবায়ু তহবিলের ৫০৮ কোটি টাকা এই ব্যাংক আদৌ ফেরত দিতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ফারমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। বর্তমান সরকারের আমলেই ফারমার্স ব্যাংক অনুমোদন পেয়েছিল। তখনো অর্থমন্ত্রী ছিলেন মুহিত। ওই সময় নতুন ব্যাংকগুলো অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তথা দলীয় বিবেচনার কথা তিনিও স্বীকার করেছিলেন। ঋণ কেলেঙ্কারি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে চাপের মুখে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে হয় মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীমকেও এরপর অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে শত শত কোটি টাকা অনিয়ম দেখে ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর এ অবস্থার মূল কারণ, অস্তিত্বহীন ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে। শুধু ফারমার্স ব্যাংকে নয়, প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও মূলধন জোগান থেকে ঋণ দেয়াসহ সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ৭০১ কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের দায়ে ব্যাংকটির এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে যাত্রা করা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯১ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের টাকা লোপাট নিয়ে মামলা চলছে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু দীর্ঘ দিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার পর এখন দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজিরা দিচ্ছেন। অপর দিকে সোনালী ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক বা নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা হলেও সে সময় যারা পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন, তাদের কাউকেই জবাবদিহি করতে হচ্ছে না।
ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। কিন্তু এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা কোন পর্যায়ে রয়েছে, এককথায় এর চিত্র তুলে ধরেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বিদায়ী ২০১৭ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘ব্যাংক কেলেঙ্কারির বছর’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সিপিডি মনে করছে, এ পরিস্থিতি ২০১৮ সালেও তেমন পরিবর্তন হবে না। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আগের চেয়ে এখন আরো বেশি নাজুক। সরকার যদি এখনি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে তার প্রভাব চলতি বছরেও থাকবে। এর সাথে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন আরো ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।’ ব্যাংকিং খাতে কী ধরনের অনিয়ম ঘটছে, সে প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া কয়েকটি ব্যাংক থেকে বিদেশে অর্থপাচার করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। এ বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কয়েকটি ব্যাংকে ঋণের ওপর ব্যক্তির প্রাধান্য বিস্তারের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যক্তি খাতের নতুন ব্যাংক কার্যকর হতে পারেনি। পুঁজি সঞ্চালন করে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সময় ঋণখেলাপির পরিমাণও বাড়ছে।’ সিপিডির এই মূল্যায়নে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সিপিডি বাংলাদেশকে টেনে নামানোর চেষ্টা করছে। তারা কখনো বাংলাদেশের উন্নয়ন চোখে দেখে না; শুধু নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে। বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, সিপিডি আর বিএনপির বক্তব্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা বিএনপির ভাষায় কথা বলছেন। সরকারের আরেক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেন, সিপিডি এখন পলিটিক্যাল ইকোনমি করছে।
তারা একটি রাজনৈতিক দলের তাঁবেদারি নিয়ে ব্যস্ত।’ আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী নিজে স্বীকার করেছেন ব্যাংকিং খাতে লুটপাট চলছে। কিন্তু সিপিডি কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন এই লুটপাটের দিকটি তুলে ধরেছে তখন তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকেন। ব্যাংক লুটের চেয়ে তা তুলে ধরা বা সমালোচনাকে যেন বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে কথিত দুই কোটি টাকা তসরুপের অভিযোগ এনে তাকে কারাগারে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলছেন, এক দিনের জন্য হলেও তাকে কারাগারে যেতে হবে। কিন্তু বেসিক ব্যাংক বা ফারমার্স ব্যাংকের শত কোটি টাকা লোপাটকারীদের জেলে যেতে হয় না। বরং দাবি করেছেন আরেকবার যদি দায়িত্ব পান তাহলে লোপাট করা টাকা ফিরিয়ে আনতে পারবেন। ব্যাংক খাতে যে অস্থিরতা, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ঋণ জালিয়াতি। ফলে খেলাপি ঋণের লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। দেশে ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে বর্তমানে ১৮টি ব্যাংক নানাভাবে আর্থিক ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে এক ডজনেরও বেশি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যাংকগুলোর লাখ লাখ আমানতকারী। প্রশ্ন হচ্ছে, আর্থিক খাতের এ অস্থিরতার দায় কে নেবে? অবশ্যই এ দায় অর্থ মন্ত্রণালয় তথা অর্থমন্ত্রী এড়াতে পারেন না। কারণ, দেশে সরকার আছে। আছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের অনেক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি ব্যাংকের এসব লুটপাটের দায়ও সরকারের দায়িত্বশীলরা এড়াতে পারবেন না। কেননা ব্যাংকের অনুমোদন তারাই দিয়েছেন। ক্ষমতাসীনদের মদদে আসলে কৌশলে ব্যাংক ডাকাতির নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। এই পদ্ধতির একটি হচ্ছে, নতুন ব্যাংক খুলে আমানত সংগ্রহ করে তা পাচার করা। অপরটি হচ্ছে, পুরনো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া। একবার টাকা নেয়ার পর তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। ব্যাংক লুণ্ঠনের এই নতুন পদ্ধতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সম্প্রতি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে তা পাস হয়েছে। নতুন এ আইনের কারণে একই পরিবারের চারজন সদস্য যেকোনো বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন। আগে এই সংখ্যা ছিল দুইজন। এ ছাড়া তিন বছর করে পরপর দুই মেয়াদে তারা ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারতেন মোট ছয় বছর। এখন নতুন আইনে তিন বছর করে তিন মেয়াদে মোট ৯ বছর পরিচালক থাকতে পারবেন একাধারে। এর ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলত ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম হবে। একটি বেসরকারি ব্যাংকে মাত্র ১০ শতাংশ অর্থের মালিকানা হচ্ছে পরিচালকদের, বাকি ৯০ শতাংশ টাকা জমা রাখেন সাধারণ আমানতকারীরা। মাত্র ১০ শতাংশ অর্থের মালিকদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে ব্যাংকগুলোকে কার্যত পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার আইন পাস করা হলো। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন পুরো ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মুষ্টিমেয় পরিচালকের স্বার্থরক্ষার এমন প্রচেষ্টার বিষয়কে ব্যাংকার, আমানতকারী, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও সমর্থন করেনি। একটি ব্যাংকের সাফল্য নির্ভর করে আমানতকারীদের বিশ্বাস ও আস্থার ওপর। ব্যাংক যদি নিছক একচেটিয়া পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তাহলে সেই ব্যাংকের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা আর থাকার কথা নয়। দেশের ব্যাংকিং খাতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন তা আরো বাড়িয়ে দেবে। কার্যত ব্যাংকিং খাতে লুটপাট এবং পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে সিন্ডিকেটেড ঋণের পরিমাণ বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিকে শেষ পর্যন্ত হুমকির মুখে ফেলবে। এর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা অনেকটা খর্ব হয়ে যাবে। শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, দেশের অর্থনীতি এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ব্যাংক, ব্যবসায় ও বিনিয়োগ- তিন খাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক ধরনের মাফিয়াতন্ত্র। সরকারসমর্থক হিসেবে পরিচিত কিছু ব্যবসায়ী এখন দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন। অর্থমন্ত্রী কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত তাদের কাছে অসহায়। কিন্তু শেষ বিচারে দেশের ব্যাংকিং খাতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, এর দায় অর্থমন্ত্রীকে নিতে হবে। তিনি ‘রাবিশ’ বলে এই দায় নেয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারবেন না।
alfazanambd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.