শীত, কুয়াশা আর ধোঁয়াশা

গ্রাম বাংলায় শীত মানে কুয়াশার চাদরে ঢাকা সরিষার ক্ষেতে রাঙা ফুলের হলুদ চাহনি, পাকা ধানের ক্ষেতে নবান্নের আবাহন, রাস্তার ধারে ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু জলের হাসি, গাঁদাফুলের পরাগে প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর খেলা, কচুগাছের সবুজ পল্লবে থরে থরে সাজানো মায়াবী জলের ফোঁটা, কুয়াশাসিক্ত কলাপাতার শ্যামল বিছানা, নদীর ওপারে ধোঁয়াশার স্বপ্নমাখা শুভ্রবসনা মোহময়ী দেবীর শাড়ির আঁচল, লজ্জাবতী লতার আলতো ছোঁয়ার জলীয় কম্পন, রহস্যময়তায় ভরা বন-বনানীর আধো আলো আধো ছায়ার স্বপ্নিল মায়া, গাছের ডগায়, নদীর জলে আর পদ্মপুকুরে কুয়াশায় ঘেরা নিঃসীম সাদার মায়াজাল, টিনের চালে রাতভর কুয়াশার বৃষ্টি, কাকভোরে আগুন পোহাতে গোল হয়ে বসে মায়ের হাতে খড়-কাঠের আগুনে পোড়ানো পিঠা খাওয়া, সকালের অলস রোদে গাছির কোমরে দোলানো খেজুর রসের কলসি থেকে নেয়া আকণ্ঠ তাজা রসপান, সবজি ক্ষেতে কাকভোরে কৃষকের ছাই ছিটানো, গরু-ছাগলের পাল নিয়ে রাখাল বালকের ঘাসমাঠের দিকে ছুটে চলা, গামছা মাথায় কৃষ্ণ গায়ে চাদর মোড়ানো গাড়িয়ালের মেঠোপথে গরুর গাড়ি নিয়ে দুলকি চালে দূর পথ পাড়ি, ঠকঠক শীতে লাঠি হাতে জবুথবু লাঠিবুড়ির এলোমেলো পথচলা। শীত মানে মাঠে মাঠে গোল্লাছুট আর ফসলকাটা ক্ষেতে হাডুডু খেলার শিহরণ, হাঁটুপানিতে জাল ফেলে পড়ন্ত বিকালে ঢেউহীন নদীতে মাছ ধরা, নবান্নের উৎসবে কৃষাণীদের মেতে ওঠা, নতুন বৌয়ের বাপের বাড়ি নাইওর যাওয়া, খড় বিছানো আঙ্গিনায় জোছনার হাসির বন্যায় শিশু-কিশোরদের হল্লা, রাস্তার ধারের চা দোকানে ধোঁয়া ওড়ানো চায়ের কাপে চুমুক দেয়া, ভেজা সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রাজনীতির ঝড় ওঠানো, বিলাস-গল্পে সময় কাটানো, পৌষ-মাঘের হিমেল সকালে উদোম গায়ে সরিষার তেল মেখে সোনালি রোদে গা বিছিয়ে দেয়া। শীত মানে হাকালুকির হাওরে ছুটে আসা পরিযায়ী পাখির ডানা ঝাপটানো উচ্ছল কলকাকলি,
ডুবন্ত সূর্যের লাল আভা মাখানো আকাশের গা ঘেঁষে ছন্দ তুলে ঝাঁক ঝাঁক পাখির কিচিরমিচির শব্দে নীড়ে ফেরা, নম্র-লাজুক ঘোমটা-টানা কৃষক-বউয়ের কলসি কাঁখে পানি নেয়া, শীত-বিকালে রাখালের হইহই তাড়নায় অলস ভঙ্গিতে ভেড়ার পালের ঘরমুখী চলা, ফসলকাটা শুকনো মাঠে কিশোর-কিশোরীদের দুরন্তপনা, লাটিম খেলা থেকে ছুটে গিয়ে রঙিন ঘুড়ির আকাশছোঁয়া। রাজধানী-শহরে শীত মানে পথযাত্রীর ধুলার সাগরে নিত্যদিন নিমজ্জিত হওয়া, নাকে-মুখে রুমাল চেপে অফিসে যাতায়াত, কেডস পায়ে মাফলার জড়িয়ে নগরের নটিদের আস্তানা ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লাল ওয়াকওয়েতে দুলকি চালে জগিং করা, ঘনকুয়াশার ঘোমটা মাথায় জবুথবু হয়ে রমনার বৃক্ষরাজির চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, আবাহনী মাঠে যুবকদের ঘাসের ডগায় উঁকি দিয়ে থাকা শিশির পায়ে দলিয়ে ফুটবল খেলায় সোল্লাসে মেতে ওঠা, সংসদ ভবনের চত্বরে সাত-সকালে সব বয়সী ডায়বেটিকদের দলবদ্ধভাবে শারীরিক কসরত আর হালকা চালে দৌড় দেয়া, শীর্ণকায় বুড়িগঙ্গার পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে ঢেউ তুলে চলে যাওয়া নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকা, সদরঘাটে কুয়াশার ফাঁকে একটু একটু দৃশ্যমান জাহাজ-লঞ্চের ভেঁপুর শব্দে আশপাশ মুখরিত হওয়া, শহরের অলি-গলিতে ধোঁয়া ওড়ানো চিতই পিঠা খাওয়া, চুলার পাশে পসরা সাজিয়ে ভাপাপিঠা বিকানো। শীতের দেশে শীত মানে আকাশের নীল গায়ে হেলান দেয়া আলস্যভরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের শুভ্র চূড়া, বরফ জড়ানো ফেনিল মাঠে স্কি খেলা, দুরন্ত শিশু-কিশোরদের বরফ ছোড়াছুড়িতে মেতে ওঠা, গ্রিনল্যান্ডে এস্কিমোদের ইগলু বানানোর হিড়িক, উত্তর মেরুতে ভৌতিক লাল-নীল-সবুজ-বেগুনি রঙের মেরুজ্যোতির লীলাখেলা, আইসল্যান্ডে উদ্গীরিত আগ্নেয়গিরির কৃষ্ণ লাভার জমিনে বরফের ছড়াছড়ি আর পাহাড়ের গায়ে কালো-শাদার জড়াজড়ি, ইউরোপের সর্বউত্তরে ছয় মাস এক নাগাড়ে সূর্যহীন জীবনযাপন, মস্কোর রেড স্কয়ারের বরফ ঢাকা চত্বরে বরফের ফাঁকে কবুতরের বেপরোয়া খাদ্য-সন্ধান, নায়াগ্রা জলপ্রপাতের জমে যাওয়া পানির অপূর্ব সৌন্দর্যময়তা, নিউইয়র্ক শহরের বরফ ফোয়ারা আর হাডসন নদীর বরফাবৃত পানির গতিহীনতা, সাইবেরিয়ায় মধ্য-জানুয়ারির মাইনাস অর্ধশত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভয়ংকর সুন্দর হিমবাহ, আঙিনায় দাঁড়ানো কন্যাটির মুহূর্তে জমে যাওয়া বরফ মোড়ানো চোখের পাপড়ি।
ড. এম এ মাননান : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.