‘বস্ত্রহীন রাজা’ by হাসান ফেরদৌস, যুক্তরাষ্ট্র

একই সঙ্গে দুই রণক্ষেত্রে লড়তে হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে; উভয় ক্ষেত্রেই তিনি এই মুহূর্তে ভীষণ কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। ট্রাম্পের প্রথম লড়াই একটি বইয়ের সঙ্গে। মাইকেল উলফ নামের একজন সাংবাদিক ৩৩৬ পৃষ্ঠার একটি ঢাউস বই লিখেছেন, নাম ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি। প্রায় ১৮ মাস ধরে, প্রথমে নির্বাচনী প্রচারণার সময়, পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে তাঁর প্রথম ছয় মাসে ট্রাম্প ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন উলফ। এই সময় ট্রাম্প ও তাঁর ঘনিষ্ঠ এমন মানুষদের সঙ্গে প্রায় ২০০ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। উলফের দাবি, ট্রাম্পই তাঁকে এ রকম খোলামেলা একটি বই লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ‘এই সময় আমি কার্যত হোয়াইট হাউসে একদম প্রথম সারির চেয়ারে বসা একজন দর্শক ছিলাম’, তিনি লিখেছেন। ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত এই বইয়ে উলফ ট্রাম্পের সব বস্ত্র এক এক করে উন্মোচন করে তাঁকে কার্যত নির্মোক করে ছেড়েছেন। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের যে ছবিটি উলফ এঁকেছেন তা একদিকে অদক্ষ, বিশৃঙ্খল এক প্রশাসনের ছবি, অন্যদিকে একে অপরের গলায় ছুরি বসাতে সদা ব্যস্ত এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিবরণ। উলফের উদ্ধৃতি অনুসারে, রাজস্ব মন্ত্রী স্টিভ মিনুশিন ও সাবেক চিফ অব স্টাফ রেইন্স প্রিবাসের কথায়, ট্রাম্প একটি মূর্খ (‘ইডিয়ট’), অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গ্যারি কনের কথায়, ‘তিনি বিষ্ঠার ন্যায় বুদ্ধু’, (‘ডাম্ব অ্যাজ শিট’) এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকমাস্টারের কথায়, ‘লোকটা আস্ত আফিমখোর’ (‘ডোপ’)। ব্রিটিশ মিডিয়া ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে যে ভাষায় বর্ণনা করে, বাংলায় তা প্রকাশযোগ্য নয়। এর আগে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন তাঁকে ‘নির্বোধ’ (‘মরোন’) বলে ভর্ৎসনা করেছিলেন, তাতে ক্রুদ্ধ ট্রাম্প টিলারসনকে বুদ্ধি পরীক্ষার ডুয়েল লড়াইয়ে আহ্বান করেছিলেন। নিউ ইয়র্কার পত্রিকার জন ক্যাসিডি লিখেছেন, উলফ ট্রাম্পের যে ‘পোর্ট্রেটটি’ এঁকেছেন, তা এককথায় ‘বিধ্বংসী’। অথচ উলফের মূল বক্তব্য, ট্রাম্প অযোগ্য, সে কথা মোটেই অজ্ঞাত নয়। নিক্সন লাইব্রেরির সাবেক প্রধান টিম নাফতালি বলেছেন, এ কথা জানার জন্য উলফের বই পড়ার দরকার নেই।
এই বইয়ের ব্যাপারে ট্রাম্প যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাতে বোঝা যায় এতে উন্মোচিত তথ্যসমূহ ভিত্তিহীন নয়। ট্রাম্প নিজে দাবি করেছেন, উলফের সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি। অন্যদিকে উলফ বলছেন, তাঁর কাছে ট্রাম্পের সঙ্গে কথোপকথনের নোট ছাড়াও টেপ রেকর্ডিং রয়েছে। হোয়াইট হাউসে কর্মরত একাধিক সাংবাদিক জানিয়েছেন, সবুজ কার্ড বুকে ঝুলিয়ে উলফকে সেখানে বিনা বাধায় আসা-যাওয়া করতে তাঁরা দেখেছেন। বইটি যাতে প্রকাশ ও বিক্রি না হয়, তার নির্দেশ দিয়ে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী চিঠি পাঠিয়েছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। মার্কিন গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। আদালতে বিচার চাইলে কোনো বিচারক বই নিষিদ্ধ করার অনুরোধ সমর্থন করবেন বলে মনে হয় না। ট্রাম্পের আইনজীবীর চিঠির জবাবে গ্রন্থের প্রকাশক হেনরি হল্ট অ্যান্ড কোম্পানি তার প্রকাশনা তিন দিন এগিয়ে এনে শুক্রবার বাজারে ছেড়েছে। কোনো কোনো শহরে শুক্রবার মধ্যরাতের পর বইটি বিক্রি শুরু হলে কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে হাজার হাজার লোক বইয়ের দোকানে ভিড় জমায়। প্রকাশের আগেই বইটি বেস্ট সেলার হয়ে উঠেছে। ট্রাম্প মুখ না খুললে এসবের কোনোটাই হয়তো হতো না। এদিকে ঠিক একই সময় ফায়ার অ্যান্ড ফিউরির চেয়েও বড় এক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে ট্রাম্পকে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, গত বছরের মার্চে রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত প্রশ্নে তদন্তের কথা উঠলে আইনমন্ত্রী জেফ সেশন্স নিজেকে এই তদন্তের সব বিষয় থেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে ট্রাম্প এত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে তিনি নিজের ব্যক্তিগত আইনজীবী ডোনাল্ড ম্যাকগেহনকে এ কাজ না করার নির্দেশ দিয়ে সেশন্সের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বিচার বিভাগ ও হোয়াইট হাউসের মধ্যে যে ক্ষমতার বিভাজন আছে, এই বিষয়টি ট্রাম্প জানতেন না অথবা জেনেও তা লঙ্ঘন করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এই তথ্য যদি সত্য হয় তাহলে ট্রাম্প বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলারের পক্ষে তা প্রমাণ অনেক সহজ হবে। বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক টাইমস-এ এক উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে চারজন খ্যাতনামা আইনজীবী লিখেছেন, সব ঘটনাক্রম বিবেচনা করলে কোনো সন্দেহই থাকে না যে ট্রাম্প রাশিয়া প্রশ্নে বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। ডেমোক্রেটিক সিনেটর রিচার্ড ব্লুমেনথলও সিএনএনকে একই কথা বলেছেন। উলফের বইয়ে নতুন যে তথ্য এসেছে, তাতেও এই সন্দেহ ঘনীভূত হয়। উলফ লিখেছেন, গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প জুনিয়র ও ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের একাধিক সদস্য ট্রাম্প টাওয়ারে রুশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপারে ক্ষতিকর তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে যে বৈঠক করেন, ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন তাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করেছেন। উলফের প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, নিউইয়র্ক টাইমস-এ এই বৈঠকের খবর প্রকাশিত হলে ট্রাম্প নিজে তা অস্বীকার করে এক বিবৃতি প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দেন। তিনি মৌখিকভাবে নির্দেশ দেন, ট্রাম্প জুনিয়র যেন জানায় ওই বৈঠকে রুশ শিশুদের দত্তক গ্রহণের প্রশ্নে আলোচনা হয়, অন্য কোনো ব্যাপারে নয়। কথাটি যে সত্য নয়, সে কথা অবশ্য দুই পক্ষের মধ্যে ই-মেইল চালাচালি থেকেই স্পষ্ট। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহ এখনো শেষ হয়নি, এরই মধ্যে নিজের অধিকাংশ বস্ত্র খুইয়ে বসে আছেন ট্রাম্প। নিজেকে বাঁচাতে তিনি রাশিয়া তদন্ত বাতিলের জন্য বিশেষ কৌঁসুলি ম্যুলারকে বরখাস্ত করার পাঁয়তারা করছিলেন বলে জল্পনাকল্পনা রয়েছে, কিন্তু সে কাজটি করা এখন সম্ভবত খুব সহজ হবে না।

No comments

Powered by Blogger.