এবার এত ঠাণ্ডা পড়ল কেন?

বাংলাদেশে গত ৮ জানুয়ারির শীত ৫০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। সে দিন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নামে ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ১৯৬৮ সালে মৌলভীবাজারের চা-বাগান বেষ্টিত শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ও জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর মেরিন অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক রিসার্চের প্যাসিফিক ইএনএসও অ্যাপ্লিকেশন ক্লাইমেট সেন্টারের প্রধান গবেষণা বিজ্ঞানী ড. রাশেদ চৌধুরী এবার চরম ঠাণ্ডা কেন পড়েছে এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুর্বল লা-নিনা ও মেরু অঞ্চলের বায়ুপ্রবাহ এবারকার চরম ঠাণ্ডার জন্য দায়ী। তিনি বলেন, লা-নিনা হলে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি ঠাণ্ডা হয়, বেশি বৃষ্টি হয়। পূর্ব প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নিচে নেমে গেলে এ ধরনের একটি ক্লাইমেট বা ওয়েদার এনোম্যালি হয়ে থাকে। এর প্রভাব সারা পৃথিবীতে এমনকি বাংলাদেশেও পড়ে। সে রকম একটি প্রভাব ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে লক্ষ করা যাচ্ছিল যেটা নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে প্রকটভাবে দেখা দেয়। এবারের লা-নিনাটি কিছুটা দুর্বল প্রকৃতির। আমরা যদি ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের শক্তিশালী লা নিনার সাথে এবারেরটা তুলনা করি তাহলে দেখি যে, এবারেরটা তেমন শক্তিশালী নয়। তারপরও লা-নিনার যে স্বাভাবিক প্রভাব পড়ার কথা এবার সেটাই ঘটেছে; কিন্তু তারপরও প্রশ্ন উঠেছে, ‘এই দুর্বল লা-নিনার সময়ে এত ঠাণ্ডা পড়ল কেন? স্বাভাবিক লা-নিনার সময় তো এত ঠাণ্ডা পড়ে না।’ এ প্রসঙ্গে জলবায়ু বিজ্ঞানী রাশেদ চৌধুরী বলেন, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ার পেছনে বিশ্বের ক্লাইমেট বিশেষজ্ঞরা মেরু অঞ্চলের ঠাণ্ডা বায়ুপ্রবাহকে (আর্কটিক সার্কুলেশন) দায়ী করছেন। আর্কটিক সার্কুলেশনের কারণে শীতকালে আমেরিকার আলাস্কাতে প্রচুর তুষারপাত হয় এবং অনেক ঠাণ্ডা অনুভূত হয়; কিন্তু বিজ্ঞানীরা এবার লক্ষ করেছেন যে, এবার আলাস্কাতে সে রকম ঠাণ্ডা অথবা তুষারপাত হয়নি।
এবার আলাস্কাতে ঠাণ্ডা না পড়ে আমেরিকার মেইন ল্যান্ডে প্রচুর ঠাণ্ডা পড়েছে, তুষারপাতও হয়েছে। ফ্লোরিডার মতো জায়গায় যেখানে তুষারপাত হওয়ার কথা ছিল না সেখানেও এ বছর তুষারপাত হয়েছে। ক্লাইমেট বিশেষজ্ঞরা মেরু অঞ্চলের জেট স্ট্রিম এবং ভোরটেক্সকে (হিম শীতল বায়ুপ্রবাহ) ঠাণ্ডা পড়ার আরেকটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটা ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরে মেরু অঞ্চলের কাছে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা বায়ুপ্রবাহ ধরে রাখতে সহায়তা করে। মেরু অঞ্চলের বিশাল এলাকার লঘুচাপ ও ঠাণ্ডা বায়ু গ্রীষ্মকালে দুর্বল হয়ে যায় এবং শীতকালে শক্তিশালী ও প্রসারিত হয়ে জেট স্ট্রিমের সাথে দক্ষিণ দিকে তাড়িত হয় ঠাণ্ডা বায়ুর সাথে। ২০০০ সাল থেকেই জেট স্ট্রিম দুর্বল এবং গতি ধীর হতে শুরু করে। যখন এ রকম ঘটে তখন মেরু অঞ্চলের বায়ু দক্ষিণ দিকে এবং কোনো কোনো সময় একেবারে দক্ষিণ দিকে নেমে যায়। চলতি জানুয়ারি মাসে চরম ঠাণ্ডা পড়ার পেছনে এটাও কারণ। এ রকম ঘটনা ২০১৪’র জানুয়ারি মাসেও ঘটেছিল এবং আরো পেছনে ১৯৮৯, ১৯৮২ এবং ১৯৭৭ সালে এমন ঘটনা ঘটে। রাশেদ চৌধুরী জানান, ‘অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জেট স্ট্রিম দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।’ তাহলে বাংলাদেশে কেন শীত পড়েছে এ প্রশ্নের জবাবে রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘আর্কটিক সার্কুলেশনের প্রভাব তো আছেই, একই সাথে আমি বলব বাংলাদেশের তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ঘটার পেছনে জেট স্ট্রিম প্রবাহের প্রভাবও কাজ করছে। মেরু অঞ্চলের ঠাণ্ডা বায়ু সাইবেরিয়া থেকে তাড়িত হয়ে হিমালয়ে আঘাত করে এবং পরে হিমালয়ের পাশ দিয়ে এসে বাংলাদেশে আছড়ে পড়ে। আবার জেট স্ট্রিমের সাথে শীতকালীন লা-নিনার প্রভাবও আছে।’ বাংলাদেশ সব সময় এল-নিনো বা লা-নিনার দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত বলে রাশেদ চৌধুরী জানান। লা-নিনা সাধারণত এপ্রিল, মে অথবা জুন মাসে গঠিত হয় এবং আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর অথবা নভেম্বর মাসে সর্বোচ্চপর্যায়ে পৌঁছে; কিন্তু এবারের লা-নিনা শীতকালীন এবং এটা গঠিতই হয়েছে অক্টোবর মাসে। এ সময়ে গঠন হলে শীতকালটা সাধারণত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের এবারের শীতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার অন্যতম কারণ এটা। ভবিষতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশে আর কী প্রভাব পড়তে পারে এর উত্তরে রাশেদ চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ুর মডেলগুলো দেখাচ্ছে যে, আগামী দিনে এল-নিনো ও লা-নিনার ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাবে অর্থাৎ এল-নিনো ও লা-নিনা ঘন ঘন হতে পারে। এমন হলে গরমের সময় প্রচুর গরম পড়বে এবং শীতের সময় প্রচুর ঠাণ্ডা পড়বে। সে পূর্বাভাস থেকে বলা যায় যে, এ বছর যতটুকু ঠাণ্ডা পড়ার কথা এর চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, আমেরিকায় যখন মানুষ ঠাণ্ডায় কাবু ঠিক একই সময়ে অস্ট্রেলিয়া গরমে পুড়ছে, মানুষ টিকতে পারছে না সেখানে। এল-নিনো ও লা-নিনা ঘন ঘন হওয়ার সময় পৃথিবীর কোনো এক জায়গায় প্রচুর ঠাণ্ডা হবে আবার একই সময় অন্য জায়গায় প্রচুর গরম পড়বে। অস্ট্রেলিয়াতে গত ৭ জানুয়ারির তাপমাত্রা ছিল ৪৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৮৩৯ সালের পর অস্ট্রেলিয়াতে এটা ছিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ১৯১৮, ১৯৫৭, ১৯৮৮ ও ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী ফ্লু’র প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। ইনফ্লুয়েঞ্জার আক্রমণে বিশ্ব বিপর্যস্ত ছিল। এটা হয়েছে লা-নিনার পরের সময়টুকুতেই। অর্থাৎ লা-নিনা গঠনের পরের বছর ফ্লু’র আশঙ্কা থাকতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.