নেতানিয়াহুর ভারত সফর : একই আদর্শ একই শত্রু

নেতানিয়াহু ও নরেন্দ্র মোদি বিশ্বব্যবস্থায় এমন একটি অংশীদারি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেনÑ যা হবে একচেটিয়া জাতীয়তাবাদী মনোভাব দ্বারা উৎসাহিত, বাছাই করা এবং অতীতের পৌরাণিক কাহিনীর আদর্শে অনুপ্রাণিত। নরেন্দ্র মোদি একমাত্র ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো ইসরাইল সফর করেছেন এবং ইহুদিবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও আধুনিক ইসরাইলের আধ্যাত্মিক গুরু থিওডোর হার্জেলের সমাধি পরিদর্শন করেন। ৬৭ বছরের পুরনো এ জায়গাটিতে একটা কালো মার্বেলের চূড়ায় ছোট পাথর বসানো আছে, যা জেরুসালেমের মাউন্ট হার্জেল নামে পরিচিত। এ দিকে ১৪ জানুয়ারি নেতানিয়াহু দ্বিতীয় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফর করছেন। দিল্লির মহাত্মা গান্ধী স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করবেন তিনি; যদিও ইসরাইল ও ভারতের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য ছিল। এটি সত্যিই এক বিস্ময় যে, ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে ইসরাইল। গান্ধী ক্রমাগতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিবাদী কার্যক্রমে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত ছিলেন। জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর নিপীড়ন চালানোর ফলে ১৯৩৮ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য আলাদা দেশ গঠনের যে ডাক দেয়া হয় তা থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেন গান্ধী, যা ভারতের ‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার সহানুভূতি সব ইহুদির জন্য।’
তিনি আরো লিখেছিলেনÑ ‘কিন্তু আমার সহানুভূতি ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা থেকে আমাকে দূরে সরাতে পারবে না। ইহুদিদের জন্য আলাদা দেশ গঠনের উদ্যোগ তাই আমার কাছে কোনো আবেদন তৈরি করে না। এই শাস্তির কথা বাইবেলেই উল্লেখ করা হয়েছে।’ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বাইবেলে উল্লিখিত ধারণা ভৌগোলিক সীমা নির্দেশ করে না। তাই তারা যদি ভৌগোলিক কারণে ফিলিস্তিনে তাদের দেশ গঠনের উদ্যোগ নেয়, তবে ব্রিটিশদের ছত্রছায়ায় এমন পদক্ষেপ হবে সত্যিকারের ভুল। ধর্মীয় কার্যক্রম অস্ত্র কিংবা বোমার সাহায্যে চলতে পারে না। একমাত্র আরবদের সম্মতিতেই তারা ফিলিস্তিনে স্থায়ী হতে পারে।’ গান্ধীর এমন মনোভাব পরিবর্তনের জন্য পরবর্তী বছরগুলোয় কমপক্ষে চারজন ইহুদিবাদী উকিল ভারত সফর করে তাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। ১৯৪৬ সালে গান্ধী লিখেছেনÑ ‘আমার মতে, ইহুদিরা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সহায়তায় ফিলিস্তিনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ার সুযোগ খুঁজেছে এবং এখন নগ্ন সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে তা করে যাচ্ছে।’ ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, ভারতের স্বাধীনতার ছয় মাস পর হিন্দু উগ্রবাদীরা গান্ধীকে খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তার এই মনোভাব ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে আরো কয়েক দশক ধরে প্রভাবিত করতে পারত। যদিও দিল্লি ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় ১৯৫০ সালে; কিন্তু পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে ১৯৯২ সালে। ২০০৩ সালে অ্যারিয়েল শ্যারন প্রথম ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফর করেন।
ক্ষমতামুখী বিজেপি উত্থান
হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশ দু’টির সম্পর্কের উন্নয়ন একেবারে কাকতালীয়। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিজেপি ১৯৮২ সালে পার্লামেন্টে মাত্র দু’টি আসন পেলেও ১৯৯১ সালে ১২০ আসন পায় এবং ১৯৯৯ সালে নিশ্চিত করে ১৮২টি আসন। তাদের এই উত্থান হয়েছে তীব্র মুসলিমবিদ্বেষী অবস্থানের কারণে। এর একটি বড় উদাহরণ, ৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা। বলা হয়ে থাকে, দেবতা রামের জন্মস্থানে বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। পালাবদলের ধারাবাহিকতায় বিজেপি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসে। ওই বছরেরই মে মাসে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। অন্য অনেক বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে নেতানিয়াহুও মোদিকে অভিন্দন জানান এবং একই সাথে বাণিজ্যের দুয়ার খুলে যায় দুই দেশের মধ্যে। মোদি নির্বাচিত হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যেই ইসরাইল ভারতে ৬৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র রফতানি করে, যা ভারতে ইসরাইলের গত তিন বছরের মোট রফতানির চেয়েও বেশি। ইসরাইল সফরের সময় হার্জেলের সমাধিতে মোদির শ্রদ্ধা জানানো নেতানিয়াহুকে খুশি করেছে। তাই নেতানিয়াহুও তার ভারত সফরে গান্ধীর স্মৃতিস্তম্ভে যাওয়ার ব্যাপারে একটু বেশিই আগ্রহী, যদিও মহাত্মা গান্ধীকে মোদি খুব কমই পছন্দ করেন। কেননা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি যে কাজটি শুরুতেই করেছেন, তা হলো- বিনায়ক দামোদর সাভারকারের প্রতিকৃতিতে সম্মান জানিয়েছেন। এ প্রতিকৃতিটি ভারতীয় পার্লামেন্টের মূল সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে, গান্ধীর স্মৃতিস্তম্ভ তার ঠিক উল্টো পাশেই অবস্থিত। ২০০৩ সালে বিজেপির উদ্যোগেই ওই প্রতিকৃতিটি স্থাপন করা হয়।
ভারতের হার্জেল
সাভারকার খুবই বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন। তাকে বলা যেতে পারে ভারতের হার্জেল। তিনিই মূলত ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারণার প্রবর্তন করেছেন। গান্ধী যেখানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, সেখানে সাভারকার চেয়েছেন হিন্দুদের আদি বাসস্থান বা ‘হিন্দুস্তান’ প্রতিষ্ঠা করতে। তার মতে, হিন্দু তারাই যারা ভারতকে তাদের মাতৃভূমি ও পবিত্র ভূমি হিসেবে গণ্য করে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারতে হাজার বছর ধরে বসবাস করা ২০ কোটি খ্রিষ্টান ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য টিকে থাকাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও এই পবিত্র মন্দির বা কুঠি ভারতের সর্বত্রই দেখা যায়। তিনি কড়াভাবেই বলতেন, তাজমহল ভারতের মাটিতে বিদেশী সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। উগ্র হিন্দুরা বলেন, ভারতের মাটিতে তাজমহলের ঠাঁই হবে না। সভারকার গান্ধীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধীই শুধু নন, গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে তার বিশেষ অনুগামী ছিলেন এবং গান্ধীকে হত্যার এক সপ্তাহ আগে সাভারকারের সাথে তার দুইবার সাক্ষাৎ হয়। অনেকেই বিশ্বাস করেন, নাথুরাম গডসে শুধু হুকুম তামিল করেছেন, মূল হোতা ছিলেন সাভারকার। এই হত্যাকাণ্ডের দায়ে সাভারকারসহ তাদের কয়েক হাজার হিন্দু জাতীয়তাবাদী জেলও খেটেছেন, যদিও হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা যায়নি। নাথুরাম হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের অঙ্গসংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আরএসএসের আজীবন সদস্য ছিলেন। এ সংগঠনের রাজনৈতিক শাখাই বিজেপি। নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকারের অনেক মন্ত্রী ছোটবেলা থেকেই আরএসএসের সদস্য।
একই লক্ষ্য
সাভারকার ও হার্জেল মূলত জাতীয়তাবাদী ধারণা ও পৌরাণিক ইতিহাসের সমর্থক হিসেবে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এই মিলই বর্তমানে দুই দেশকে একই সমতলে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ২০০৩ সালে বিজেপি শ্যারনকে যেসব কথা বলে স্বাগত জানিয়েছিল, তার ভিত্তিতেই এই পথচলা। বিজেপি সেই স্বাগত বক্তব্যে বলেছিল, ‘পুরো বিশ্ব স্বীকার করে, ইসরাইল কার্যকর ও নির্মমভাবে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস মোকাবেলা করেছে। বহু আগে থেকেই ভারত ও ইসরাইল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে একে অপরের কাছ থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। সম্ভবত এটিও আশ্চর্যের বিষয় যে, ইসরাইল এখন ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। পুরোপুরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বছর ১৯৯২ সালে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যেখানে ছিল ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে ২০১৬ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৪ বিলিয়ন ডলারে, যার একটি বড় অংশই অস্ত্র ব্যবসায়। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গাজায় পরীক্ষা চালানো ইসরাইলের তৈরী ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি চুক্তির ব্যাপারে আবার আলোচনা করতে গত বৃহস্পতিবার ভারত সম্মত হয়েছে। তবে এটি নিশ্চিত, সিদ্ধান্তে রদবদল যাই হোক, চুক্তিটি যেন হয়ে যায় তাই এক সপ্তাহ আগেই কাজ শুরু হয়। নেতানিয়াহু যদি চান তাহলে দুই দেশের ব্যবসায় আরো সম্প্রসারিত হবে। এই সফরে তিনি একা নন, ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘দ্য ক্রিম ডি লা ক্রিম’সহ কম করে হলেও ১০২টি ইসরাইলি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এসেছেন তার সাথে। যা হোক, ইসরাইলের ইহুদিবাদী ও ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা যখন একই বিশ্বাসের অনুসারী হয় তখন দুই দেশের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে নেতানিয়াহুর যে স্বপ্ন, তা একমাত্রিকও সহজ হয়ে যায়। ইসরাইল যখন সারা বিশ্বে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, সেখানে কারো অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক স্বার্থ আদায় করার জন্য ভারত খুবই জটিল একটি দেশ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইরান ভারতের একটি বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, তাই দিল্লিও চাইবে না মুসলিম দেশটি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াক আর পাকিস্তানের মতো শত্রুদেশ ক্ষেপে যাক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশ এবং দেশটির ২০ কোটি মুসলমানের ভোটও গুরুত্বপূর্ণ। জানুয়ারি মাসেই মোদির নিজ এলাকা গুজরাটের নির্বাচনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটি স্পষ্ট বার্তা পেয়েছে, চলতি পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তারা যা খুশি তাই করতে পারে না। তাই জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভারতের সাম্প্রতিক ভোট দেয়াও বিস্ময়ের বিষয় নয়। হ
লেখক : হল্যান্ডের সাংবাদিক। ২০ বছর ধরে লেবাননে বসবাস করছেন। তিনি ‘২০০০ সন্ত্রাসী’ প্রামাণ্যচিত্রের নির্দেশকদের একজন। তিনি প্রায়ই ভারত সফর করেন এবং ১৯ শতকের লেখকেরা প্রাচ্যকে কিভাবে তুলে ধরেছেন, সে বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী।
‘মিডল ইস্ট আই’ থেকে ভাষান্তর করেছেন মো: সাজেদুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.