বিলুপ্তির পথে আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ী

বিলুপ্তির পথে ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ী রাজবাড়ী। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অবহেলায় আড়াইশ বছরের পুরনো এ জমিদার বাড়ীটি কালের স্বাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে। আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ী ময়মনসিংহ জেলার অর্ন্তগত ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার একটি সমৃদ্ধ এলাকা । ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই এলাকাটি ব্যবসা-ব্যাণিজ্যে ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রসর। এমন একটি সমৃদ্ধ এলাকায় জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায়ের পরিত্যক্ত দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল জমিদার বাড়ী এখনও ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে নিরব দাড়িয়ে আছে। চমৎকার কারুকার্যময় এ রাজবাড়ীটির বয়স প্রায় আড়াই শত বছর। ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে কিছু অগ্রসর হলেই চোখে পড়বে জমিদারের বিশাল অট্টালিকা। জানা যায়, ১৭৯৩ খ্রিষ্ঠাব্দ পর্যন্ত হোসেন শাহী পরগনা রাজশাহী কালেক্টরের অধিনে ছিল। সে সময় মহা রাজ রামকৃষ্ণের জমিদারি খাজনার দায়ে নিলামে উঠলেএ পরগনাটি খাজে আরাতুন নামে এক আর্মেনীয় ক্রয় করেন। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে আরাতুনের ২ মেয়ে বিবি কেথারিনা, বিবি এজিনা এবং তার দুই আত্মীয় স্টিফেন্স ও কেসর্পাজ প্রত্যেক চারআনা অংশে এ পরগানার জমিদারী লাভ করেন। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আঠার বাড়ী জমিদার সম্ভুরায় চৌধরী, বিবি এনিজার অংশ কিংবা মতান্তরে কেসপাজেব্র অংশ ক্রয় করেন। পরে মুক্তাগাছার জমিদার রামকিশোর চৌধরী জমিদারী ঝনের দায়ে নিলামে উঠলেতা সম্ভুরায় চৌধরীর পুত্র মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরী কিনে নেন। শুধু তাই নয়, ঊঁনিশবিশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৯০৪ খ্রিষ্টব্দে) মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরীর স্ত্রী জ্ঞানেদা সুন্দরীর স্বামীর উত্তরাধিকার ও ক্রয় সূত্রে পরনায় ১৪ আনার মলিক হন। বাকী দুই আনা অন্য এলাকার জমিদাররা কিনে নেন। জমিদারী প্রতিষ্ঠার পর তাদের আয়ত্তে আসে উত্তর গৌরীপুরের রাজবাড়ী, পশ্চিমে রামগোপাল পুর, ঢৌহাখলা দক্ষিনে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেন পুর ও নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা। তাছাড়া বৃহৎত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর জেলার কয়েকটি মৌজা, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বেশ কিছু মৌজা ছিল এ জমিদারের দখলে। প্রতি বছরে নির্দিষ্ট এক সময়ে এসব জেলা শহরে স্থাপিত আঠারবাড়ী কাচারী বাড়ীতে নায়েব উপস্থিত হয়ে খাজনা আদায় করত। আজ ও এসব কাচারী আঠারবাড়ী বিল্ডিং নামে নিজ নিজ জেলায় পরিচিতি পেয়েছে। জমিদার সম্ভুরায় চৌধরীর পিতা দিপ রায় চৌধুরীর প্রথম নিবাস ছিল বর্তমান যশোর জেলায়।তিনি যশোর জেলার একটি পরগনায় জমিদার ছিলেন। সুযোগ বুঝে এক সময় দ্রীপ রায় চৌধুরী তার পুত্র সম্ভুরায় চৌধুরীকে নিয়ে যশোর থেকে আলাপ সিং পরগনায় অর্থ্যাৎ আঠারবাড়ী আসেন। আগে এ জায়গাটার নাম ছিল শিবগঞ্জ বা গোবিন্দ বাজার। দীপ রায় চৌধুরী নিজ পুত্রের নামে জমিদারি ক্রয় করে এ এলাকায় এসে দ্রুত আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হন এবং এলাকার নাম পরির্তন করে তাদের পারিবারিক উপাধি (রা) থেকে রায় বাজার রাকেন। আর রায় বাবু একটি অংশে এক একর জমির উপর নিজে রাজবাড়ী, পুকুর ও পরিখা তৈরী করেন। রায় বাবু যশোর থেকে আসার সময় রাজ পরিবারের কাজর্কম দেখাশুনার জন্য আঠারটি হিন্দু পরিবার সংঙ্গে নিয়ে আসেন। তাদের রাজ বাড়ী তৈরী করে দেন। তখন থেকে জায়গাটি আঠারবাড়ী নামে পরিচিত লাভ করে। দীপ রায় চৌধুরী মৃত্যুর পর তার পুত্র সম্ভুরায় চৌধুরী জমিদার লাভ করেন। তবে কোন পুত্র সন্তন না থাকায় তিনি নান্দাইল উপজেলায় খারুয়া এলাকা থেকে এক ব্রাম্মণ প্রমোদ রায় চৌধুরীকে দত্তক এনে লালন পালন করে এক সময় জমিদারী কর্ণধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর প্রমোদ রায় চৌধুরীর বংশধররা এখান থেকে ময়মনসিংহ জেলা সদরে চলে যান। কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়ে যায় জমিদার বাড়ি। জমিদাড়ির বিলুপ্তির পর সরকার জমিদার বাড়িকে প্রতœত্ত্ব বিভাগের অধিনে নেয়। আঠারবাড়ির জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। ওই সময় কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার (সরাসরি) শিক্ষক। এ শেষ জমিদারের আমন্ত্রণেই কবিগুরু এসেছিলেন এ জমিদার বাড়িতে। ওই সময় ‘রবীন্দ্রনাথ কী জয়’ ধ্বনি তুলে রেলস্টেশন থেকে কবিকে বরণ করা হয়েছিল। হাতির পিঠে চড়িয়ে কবিকে নিয়ে আসা হয়েছিল এ জমিদার বাড়িতে। কবিকে জমিদার উপহার দিয়েছিলেন সোনার চাবি। ৯২ বছর আগের সেই স্মৃতি আজো অম্লান। এ স্মৃতি এখনো আগলে রেখেছে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ি ডিগ্রি কলেজ। ১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম এসেছিলেন ঈশ্বরগঞ্জে। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। এ উপজেলার শিক্ষিত ও সুশীল সমাজ এক্ষেত্রে ছিলেন আবেগ উদ্দীপ্ত। অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যে ও কালের স্বাক্ষী সেই আঠারবাড়ি জমিদার বাড়ি এখন জরাজীর্ণ। পড়ে আছে অযতœ-অবহেলায়। কবির ঘুরে যাবার ৪৩ বছর পর ১৯৬৮ সালে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আঠারবাড়ি ডিগ্রি কলেজ। জমিদারবাড়িতে কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রতœত্ব বিভাগ আর এখানে কর্তৃত্ব দেখায়নি। বর্তমানে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পরে দিনে দিনে জমিদার বাড়ির মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের বিভিন্ন তৈজসপত্র সহ বিভিন্ন জিনিস লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অবহেলা অযতেœ ধ্বংসের দার প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়িতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই কিছু কিছু স্থানে চলে অসামাজিক কাজ। নিত্যদিন বসে মদ. জুয়া সহ গাঁজার আড্ডা। এ জমিদার বাড়ি এখন অসামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্র বিন্দু বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই জমিদারবাড়িটির ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। বাংলার গৌরবউজ্জল ইতিহাসের স্বাক্ষী এই জমিদারবাড়ীটি প্রতœত্ত্ব বিভাগের অধিনে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্রুত সংস্কার করা প্রয়োজন। ইতিহাসের নিদর্শন জমিদারবাড়ীটি সংস্কার কাজে প্রতœত্ত্ব বিভাগের এগিয়ে আসা উচিৎ বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল।

No comments

Powered by Blogger.