আবার দৃশ্যপটে মাহাথির

মালয়েশিয়ার রাজনীতির মাঠ এখন উত্তাল। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন চলছে। ২০১৩ সাল থেকে ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব তুন আব্দুর রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং বিরোধী দলের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগ। মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে কিংবদন্তি পুরুষ মাহাথির এই ইউএমএনওর প্রধান হিসেবেই টানা ২২ বছর দেশ শাসন করেছেন। অন্য দিকে, দ্বিতীয় দফায় সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগে আরো পাঁচ বছরের কারাভোগ করছেন মালয়েশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম। যিনি এক সময় মাহাথিরের ডেপুটি ছিলেন। মাহাথিরের এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে, তাকে ভাবা হতো মাহাথিরের পর তিনি হবেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাকে শুধু পদচ্যুত করা হয়নি, জেলে পাঠিয়েছিলেন মাহাথির। রাজনীতিতে যে শেষ কথা বলে কিছু নেই তা যেনো আবার প্রমাণ হলো। মাহাথির মোহাম্মদ গণমানুষের ডাকে শেষ কারিশমা দেখাতে ৯২ বছর বয়সেও নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হচ্ছেন। প্রধান বিরোধী দলীয় জোট পাকাতান হারাপানের প্রধান নেতা হচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম, তাতে যোগ দিয়েছে মাহাথিরের দলও। ইতোমধ্যে মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী ও আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহকে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে জোট।
চলতি বছরের আগস্টে দেশটিতে অনুষ্ঠিত হবে ১৪তম সাধারণ নির্বাচন। ইউএমএনও দলের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক জোট বারিসান ন্যাশনালের বিরুদ্ধে জয় পেতে মাহাথিরের ভক্তদের সমর্থন খুব বেশি দরকার পাকাতান হারাপানের। আপাতদৃষ্টিতে পাকাতান হারাপানের জন্য জয় এই মুহূর্তে কাম্য মূলত দু’টি কারণে। ১. দুর্নীতির দায়ে সমালোচিত নাজিব রাজাককে ক্ষমতা থেকে সরানো। ২. আনোয়ার ইব্রাহিমের মুক্তি। অপর দিকে এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে শেষ খেলাটা দেখাতে চান মাহাথির। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মনোনয়নের মূল ক্ষমতা আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে। তাকে জেল খাটানো মাহাথিরকে তিনি তার জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিজের অতীত কষ্টের কথা ভুলে মাহাথিরকেই প্রার্থী হিসেবে মেনে নিয়ে ব্যক্তির চেয়েও দল বড় আর দলের চেয়েও দেশ বড়, এটিই কাজে প্রমাণ করেছেন আনোয়ার। সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বী মাহাথির ও আনোয়ার ইব্রাহীম দু’জনকেই মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে ‘হেভিওয়েট’ ব্যক্তিত্ব হিসেবে ধরা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে দু’জনের ঐক্যের প্রক্রিয়া ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য চিন্তার কারণ বা অশনি সঙ্কেত। এক সময় শত্রুতা থাকলেও সম্প্রতি জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মাহাথির। অশ্রুসজল মাহাথির বলেন, গত ২০ বছরে তার পরিবার অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছে। আমি তাদের অনুভূতিটাও বুঝতে পারছি। আনোয়ার আমাদের দেশের জন্য করা সংগ্রামকেই প্রাধান্য দিয়েছে, আমি তার কাছে ঋণী। জোটের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, নির্বাচনে জিততে পারলে তাদের সরকারের প্রথম কাজ হবে আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য সাধারণ ক্ষমার ব্যবস্থা করা এবং এর মাধ্যমে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ খুলে দেয়া। অবশ্যই এই সিদ্ধান্তে মাহাথির উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘ইগো’ ভুলে আনোয়ারের দুয়ারে যাওয়ার সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন- আনোয়ার যেখানে কিছু মনে করছে না, সেখানে অন্যদের অতীত নিয়ে পড়ে থাকার কোনো মানে নেই। পাস্ট ইজ পাস্ট। মালয়েশিয়ার মহামান্য রাজা যদি আনোয়ারকে ক্ষমা করেন, তবে তিনি তাকেই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন দেবেন। ডা: মাহাথির মোহাম্মদ ১৬ জুলাই ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর অবসর নেয়ার পর ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে মালয়েশিয়ায় এসেছেন আরো দু’জন প্রধানমন্ত্রী। পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বাদাউইর বেশ বদনাম প্রচলিত রয়েছে জরুরি সব বৈঠকে ঘণ্টা ধরে ঝিমানোর। ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আন্দোলনকারীদের অবিরত সমালোচনার কারণে নাজিব রাজাক তাই বিদ্রোহীদের দমনেই বেশি ব্যস্ত। এ দু’জনের অযোগ্যতার কথা তুলে ধরে মাহাথির বলেন, ‘পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী আসলে হওয়া উচিত ছিল আনোয়ারেরই। মাহাথির তার অতীত সব ‘রাজনৈতিক ভুলের’ জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এখন দেখা যাক নির্বাচনে জিতে বিশ্বের প্রবীণতম সরকারপ্রধানের তকমা নিতে পারেন কিনা মাহাথির কিংবা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় কিনা আনোয়ার ইব্রাহিমের।

No comments

Powered by Blogger.