পাক-মার্কিন বিরোধের অন্তরালে by আলফাজ আনাম

পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতার সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নিয়েছে বেশ আগেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প নতুন বছরের শুরুর দিন পাকিস্তান নিয়ে এক টুইট বার্তা প্রকাশ করেন। এরপর দুই দেশের সম্পর্ক বেশ উত্তেজনায় রূপ নিয়েছে। ট্রাম্প তার টুইট বার্তায় বলেন ‘যুক্তরাষ্ট্র বোকার মতোই পাকিস্তানকে গত ১৫ বছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দিয়েছে। বিপরীতে তারা আমাদের মিথ্যা ও শঠতা ছাড়া কিছুই দেয়নি। তারা আমাদের নেতাদের বোকা ভাবছে।’ তিনি আরো লিখেন ‘আমরা আফগানিস্তানে যেসব সন্ত্রাসীকে তাড়া করছি তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে পাকিস্তান। আমাদের কোনো সহযোগিতা করছে না। আর না।’  ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর পাকিস্তান কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এমনকি আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের জন্য যে সরবরাহ লাইন তাও বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে বলে দেশটির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন। ট্রাম্পের এই টুইট বার্তার পর পাকিস্তানের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কেবিনেট মিটিং ডাকা হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়। পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করেছে। ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালের সাথে সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন ‘আমরা এমন একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যখন আফগান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পাকিস্তানের মাটিতেই যুদ্ধ শুরু হবে।’
তার দাবি সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া। তবে ইসলামাবাদ কখনো দেশের মাটিকে আফগান যুদ্ধের ময়দান হতে দেবে না। লক্ষণীয় দিক হচ্ছে ট্রাম্পের এই ঘোষণার এক সপ্তাহ আগে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস পাকিস্তান সফর করেন। এ সময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দুই দেশ এক সাথে কাজ করার অঙ্গীকার করে। ট্রাম্পের এই সাহায্য বন্ধের ঘোষণার পর ম্যাটিস বলেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে যে সহযোগিতামূলক যোগাযোগ তাতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে পাকিস্তানের সমর্থন দেশটির জন্য অপরিহার্য। এরপরও কেন যুক্তরাষ্ট্র কঠোর মনোভাব গ্রহণ করছে সে প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির এই পরিবর্তন বেশ আগেই শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের বিষোদগারও এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘পাকিস্তান বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসীদের প্রায়ই নিরাপদ আশ্রয় দেয়।’ গত বছরের ডিসেম্বরেও ট্রাম্প বলেছিলেন, সবার ভালোর জন্য তিনি হয়তো পাকিস্তানকে দেয়া সহযোগিতা বন্ধ করে দিতে পারেন। পাকিস্তান নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিবর্তন বা কঠোর অবস্থানের পেছনে আফগানিস্তানকে ঘিরে এ অঞ্চলে যে নতুন কৌশলগত মেরুকরণ শুরু হয়েছে তার প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যেখানে চীন ও পাকিস্তানের সাথে রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অপর দিকে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা যত বাড়ছে পাকিস্তানের সাথে দুই দেশের সম্পর্কে ততটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তান কৌশলগত পরিবর্তন আনে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়াতে থাকে চীন ও রাশিয়ার সাথে। একই সাথে আফগানিস্তানের বিভিন্ন ইস্যুতে চীন যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এমনকি তালেবানদের সাথে বিভিন্ন ধরনের আলোচনায় অংশ নিয়েছেন চীনা কর্মকর্তারা। ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে মতবিরোধ দূর করতে চীন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। আফগানিস্তানে চীনা প্রভাব নিয়ে পেন্টাগনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বেইজিং সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বাড়িয়ে তুলছে। এরমধ্যে গত ২৬ ডিসেম্বর বেইজিংয়ে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে ৫৭ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন আফগানিস্তান, ইরান, মধ্যএশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার সাথে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে তার দেশ খুবই আগ্রহী। আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালাহউদ্দিন রব্বানী বলেন, আফগানিস্তানের চিরদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন। দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে সংযুক্ত হওয়ার জন্য আফগানিস্তান সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। যদি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর খাইবার পাস হয়ে আমুদরিয়ার তীর পর্যন্ত যদি সম্প্রসারিত হয় তাহলে বাস্তবিক অর্থে নতুন সিল্করুটের পুনরুজ্জীবন ঘটবে। মধ্যএশিয়া হয়ে যার সাথে খুব সহজেই রাশিয়া সংযুক্ত হতে পারবে। আফগানিস্তান ঘিরে চীনের এমন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপের নেপথ্য কারণ খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে চীন। ফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট বার্তার পর চীনের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হুয়া চুনিং বলেন, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের পূর্ণ স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দেয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা পারস্পরিক শ্রদ্ধার সাথে করছে বলে আমরা খুশি। তারা এই অঞ্চল ও বিশ্বের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য এক সঙ্গে কাজ করছে। পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ইরান। একই সাথে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে অন্য মুসলিম দেশগুলোকেও ইসলামাবাদের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে তেহরান। আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে তেহরানে এক সম্মেলন শেষে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাসের খান জানজুয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর এ আহ্বান জানান ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলি শামখানি। আফগান নীতি নিয়ে পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে ইসলামাবাদের জন্য তা যথেষ্ট ঝুঁকির কারণ হতে পারে। চীন ও রাশিয়া দেশটির পাশে দাঁড়ালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে। এমনকি পাকিস্তানে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা বাড়তে পারে। ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর বাইরে দীর্ঘদিন থেকে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পুরো সময়ে পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। মস্কোর ওপর নজরদারি করার জন্য ১৯৫০ সালে পেশোয়ার বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি পায় যুক্তরাষ্ট্র। লাহোরে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা অফিস স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফরের পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় থেকে পাকিস্তান সামরিক ও বেসামরিক বিপুল সাহায্য পেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান নীতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে। পাকিস্তানের বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর আবার পাকিস্তানের সামরিক গুরুত্ব বেড়ে যায়।
আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা পায় পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন ড্রোন হামলাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে মার্কিনবিরোধী জনমত তীব্র হয়ে উঠে। আফগানিস্তানে তালেবানরা নতুন করে সংগঠিত হতে থাকে। আফগান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়ী হওয়ার অনিশ্চয়তা যতটা বাড়ছে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের ততটা অবনতি ঘটছে। আসলে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে আফগান যুদ্ধে পাকিস্তানকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলতে। আর এর মাধ্যমে এ অঞ্চলে চীন ও রাশিয়ার প্রভাব কমিয়ে আনতে। যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশল যে পাকিস্তানের জন্য আত্মঘাতী হবে তা দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। তিনি এ কারণে বলছেন ইসলামাবাদ কখনো দেশের মাটিকে আফগান যুদ্ধের ময়দান হতে দেবে না। পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ পাকিস্তান আরো বেশি চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে। ইতোমধ্যে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে তিক্ততার কারণে পাকিস্তান যদি আফগান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করে তাহলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি আফগানিস্তানে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। এই দিকটি সম্ভবত জেমস ম্যাটিস উপলব্ধি করতে পারছেন এবং পাকিস্তানের সাথে সামরিক যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন। পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আরো খর্ব করতে পারে। একমাত্র ভারত ছাড়া এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান সত্ত্বেও আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠাতে রাজি হয়নি ভারত। আফগানিস্তানে যেভাবে চীন ও পাকিস্তান সক্রিয় হয়ে উঠেছে তাতে ভারতের পক্ষে বড় ধরনের ভূমিকা রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। আফগানিস্তানে প্রভাব ধরে রাখতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে আরেক দফা আপসরফায় যেতে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকে।

No comments

Powered by Blogger.