পুতিন কেনো জিনিয়াস নন by জস কোহেন

বিশ্ব রাজনীতিতে স্মরণকালের সেরা সময় উপভোগ করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের ‘নতুন শেরিফ’ হিসেবে উত্থান ঘটেছে তার। পর্যবেক্ষকদের এমন মতের পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। গত সপ্তাহে রাশিয়ার সোচি শহরের রাশিয়ান ব্ল্যাক সি রিসোর্টে সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরানের প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। বৈঠকগুলোতে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টানার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তুরস্ক ও ইরানের সমর্থন নিয়ে একটি সিরীয় শান্তি সভার আয়োজন করতে মূল ভূমিকা পালন করেন পুতিন। লক্ষণীয়ভাবে সোচির ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।
ওই বৈঠকটিতে মধ্যপ্রাচ্যের ইস্যুই গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু, পুতিনের প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ইউরোপে, ইউক্রেনের ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ দখল ও ২০১৪ সালে ইউক্রেনের নিবাসীরা দেশটির মস্কোপন্থি প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ডনবাস অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে ইউক্রেইনকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। এশিয়ায় চীনের সঙ্গে খুব অল্প সময়ে রাশিয়া বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামপকে সহায়তা করার উদ্দেশে রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়টি এখনো পর্যন্ত দেশটির রাজনৈতিক পটভূমি দখল করেছে। প্রশাসনের আইনি এজেন্ডার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়টি। রাশিয়ার জন্য এগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ সফল অর্জন। বিশেষ করে সাবেক এই সুপারপাওয়ার যেহেতু বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় রক্তশূন্য অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে রাশিয়ার জিডিপি হচ্ছে, ১ লাখ ২৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার- যা  কোনোরকমে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির মাত্র ৭ শতাংশ। এই হিসেবে পুতিন বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার কার্ড খেলছে। এসব সত্ত্বেও পুতিনের আপাত সফলতা অদূর ভবিষ্যতে ব্যর্থতা হিসেবে দেখা দিতে পারে। মাস্টার কৌশলবিদ হিসেবে তার জনপ্রিয়তার কারণে এ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না যে, তার অর্জনগুলো তার মুখের ওপরেই বিস্ফোরিত হতে পারে।
ইউক্রেনের বিষয়ে: রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবেই ইউক্রেন দখলের চেষ্টায় ছিল। পাশাপাশি পুতিন চায়না যে, দেশটি মস্কোর কক্ষপথ ছেড়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে যোগ দিক। ক্রিমিয়া দখলের পর ক্রেমলিন আশা করেছিল যে, ক্রেমলিন ভিত্তিক এজেন্ট, স্থানীয় সহায়তাকারী ও অগোছালো রুশ সেনাদের একটি জোট নিয়ে ইউক্রেনের পুরো দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল দখল করে নেবে। তৎকালীন সময়ে পুতিনের এই ‘নভোরোশিয়া’ বা নতুন রাশিয়া তৈরির স্বপ্ন অনেকটা বাস্তবায়নযোগ্যই মনে হয়েছিল। কেননা, ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত সেনার সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ হাজার কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিস্থিতি তার পরিকল্পনা মতো আগায়নি। সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক থেকে ইউক্রেনের জনসংখ্যাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- ইউক্রেনিয়ান ভাষী, ইউরোপ বংশোদ্ভূত পশ্চিমা অর্ধেক ও রাশিয়াপন্থি রুশ-ভাষী পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাক্র অধিবাসী। ইউক্রেনের ওপর পুতিনের যুদ্ধ ইউক্রেনবাসীদের মধ্যে তাদের জাতীয় পরিচয়ের অনুভূতি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে অর্থায়নকৃত সামরিক ব্যাটালিয়ন ও বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবীরা ইউক্রেনের সরকারি সামরিক বাহিনীকে রাশিয়া-সমর্থনকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী ও স্থানীয় সহায়তাকারীদের পিটিয়ে ফেরত পাঠাতে সাহায্য করেছিল। ইউক্রেনজুড়ে সামপ্রতিক চালানো এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ইউক্রেনীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ নিয়ে সচেতনতা ২০১৪ সাল থেকে ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইইউ ও ন্যাটোর মতো পশ্চিমা সংগঠনে যোগ দেয়ার জন্য সমর্থন লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে রাশিয়া-বিরোধী প্রবণতাও। যদিও ক্রেমলিন আশা করতেই পারে যে, একসময় তাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবেই। সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের মতো রাশিয়াপন্থি কেউ পুনরায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের গদিতে বসবেন। কিন্তু সেগুলো বোধহয় বাস্তবে ঘটা অসম্ভব। মস্কোর ক্রিমিয়া দখল ও ইউক্রেনের পশ্চিমাংশে চালানো যুদ্ধে তারা লাখ লাখ রাশিয়াপন্থি, ন্যাটো ও ইইউ বিরোধী ভোটার হারিয়েছে। সহজভাবে, পুতিন হয়তো ক্রিমিয়ার দখল নিতে পেরেছেন। কিন্তু পাশাপাশি তিনি ইউক্রেনের বাকি অংশ হারিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ-হস্তক্ষেপও পুতিনের পরিকল্পনা মতো কাজ করেনি। ক্রেমলিনের আশা ছিল যে, ট্রামপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলে দুই দেশের মধ্যে সমপর্ক ঘনিষ্ঠ হবে। যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা রাশিয়াপন্থি নীতিমালা অনুসরণ করবে। আদতে ঘটেছে তার উল্টোটা। গত এপ্রিল মাসে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সমপর্ক নতুনভাবে গড়ে তোলার এবং উত্তর কোরিয়া থেকে আফগানিস্তান ও সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে যেসব বৈশ্বিক ইস্যুতে সহযোগিতার যে গোপন প্রস্তাব পুতিন দিয়েছিলেন তার কোনোটারই কোনো প্রকারের বাস্তবায়ন হয়নি। আগস্ট মাসে মার্কিন কংগ্রেস প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিল পাস করেছে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে- পুতিনের মিত্রদের উদ্দেশ্য করে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি কংগ্রেস এটাও নিশ্চিত করে যে, ট্রামপ যেন কোনোভাবে কংগ্রেসের অনুমতি ব্যতীত পূর্বে আরপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে না পারেন।
পুতিনের আরো প্রত্যাশা ছিল যে, ট্রামপ জয়ী হলে ন্যাটো দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু ট্রামপ তার প্রত্যাশার বিপরীতে গিয়ে ন্যাটো ও ন্যাটোভুক্ত মিত্রদেশগুলোর প্রতি ওয়াশিংটনের প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করেন। ট্রামপ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয়টি যে সত্যিকারেই গুরুত্ব দিচ্ছেন তা প্রমাণ করতে বালটিকে আমেরিকান সেনা মোতায়েন করেছেন। পাশাপাশি পোলিশ-রুশ সীমান্তেও অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করছেন। আর ট্রামেপর এই সঙ্গত দাবির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররাও অবশেষে তাদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক বাজেট বাড়াচ্ছেন। চূড়ান্তভাবে ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় করার জন্য কাজ করবেন- ক্রেমলিন এখনো এই আশা ধরে রেখেছে। কিন্তু আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এমনটি ঘটতে বাধা দিচ্ছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস ম্যাটিস, সিআইএ পরিচালক মাইক পম্পেও, জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচআর ম্যাকমাস্টারসহ  ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার কিছু সদস্য রাশিয়ার বিষয়ে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। মনে করা হচ্ছে, রাশিয়া-আমেরিকা সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে ট্রাম্পের কোনো পদক্ষেপ তারা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। এমনকি ট্রাম্প যদি দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে চান, তাও অসম্ভব হতে পারে। কেননা মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়ে এখনো ট্রাম্প, তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও উপদেষ্টাদের সন্দেহ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের ঘটনা তদন্তে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন ট্রাম্প। তিনি যে রাশিয়ার ‘সিক্রেট’ পুতুল নন, এই বিষয়টি প্রমাণ করা কঠিন হবে।
এদিকে, চীনের সঙ্গে পুতিনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় গুটি কয়েক আমেরিকান যে হুমকির আশঙ্কা তুলে ধরেন, আদতে বিষয়টি অত গুরুতর নয়। চীনের অর্থনীতি রুশ অর্থনীতির তুলনায় অনেক বড়। এই অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যতার কারণে দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি হলে রাশিয়া হবে তার ছোট অংশীদার। চীনের সঙ্গে মস্কোর সামরিক সহায়তার বিষয়টিও খালি চোখে যা দেখা যায়, তার থেকে কম। যদিও দুই দেশের যৌথ সামরিক মহড়া বেড়েছে। তবে এগুলো পশ্চিমাবিরোধী কোনো জোট গঠন করার জন্য নয়। এমনকি বেইজিংয়ের কাছে সর্বাধুনিক অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে মস্কোর আগ্রহ পুতিনের জন্য খারাপ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কেননা এতে দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান খর্ব হতে পারে। কয়েক দশক ধরে চলা আস্থাহীনতাকে অগ্রাহ্য করেই সম্পর্ক উন্নয়ন করছে করছে ইউরোপ ও এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দুই শক্তি। তাদের এই আস্থাহীনতা এখনো রয়েছে। কোনো দিন যদি চীন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে রাশিয়ার কাছে আবারো ঐতিহাসিক সাইবেরিয়া অঞ্চল দাবি করে বসে, তখন স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তাকে বিসর্জন দেয়ার ক্ষেত্রে পুতিনের সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করতে হবে। খুব পরিষ্কারভাবে পুতিন কিছু রাজনৈতিক অর্জনের কথা উল্লেখ করতে পারেন। সিরিয়ার বিষয়ে তার সফল কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোও তার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বিভিন্ন সময়ে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সিরিয়ায় ইসরাইলের স্বার্থের বিষয়টি দেখার জন্য পুতিনকে অনুরোধ করেছেন। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো প্রথম সৌদি নেতা হিসেবে ১৫০০ প্রতিনিধি নিয়ে বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ মস্কো সফর করেছেন। অনেক পর্যবেক্ষক এই সফরকে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দুই দেশ বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য অত্যাধুনিক এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার চুক্তিও রয়েছে।
পুতিন হয়তো মধ্য প্রাচ্যের শক্তিগুলোর মধ্যে সমঝোতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, কিন্তু তার অর্জন খুবই সামান্য। এখন এটা বোঝা যায় যে, তার ভূরাজনৈতিক ‘জিনিয়াস’ হওয়ার দাবি বাস্তবতার থেকে কল্পনা-ই বেশি।  
(রয়টার্সে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.