যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল ভারত-পাকিস্তান

পাকিস্তান ১৯৭১ সালের আজকের দিনে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে ৩ ডিসেম্বর রাতেই ভারতীয় বিমানবাহিনী বাংলাদেশে আক্রমণের পর ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় স্থলবাহিনীও বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নভেম্বর মাস থেকে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে এলেও আজকের দিন থেকেই মূলত তাদের স্থলবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে সব দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আট মাস ধরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষের সহায়তায় জীবনবাজি রেখে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র লড়াই করে আসছিলেন তা একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এ যুদ্ধ আরো বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে। কারণ একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তখন পাকিস্তানের পক্ষে আর ভারতের পক্ষে সোভিয়েত রাশিয়া। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে গোটা উপমহাদেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার একটি পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন। পরিস্থিতি সামাল দিতে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক ডাকে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার জন্য মার্কিন পক্ষ থেকে ভারতকে দায়ী করা হয়। যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইতালি, জাপান, বেলজিয়াম যুদ্ধবিরতির খসড়া উপস্থাপন করে। নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্যাপক পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা এবং উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করা হয়। তবে যুদ্ধ আর ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ বা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারেনি। এর কারণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান পাকিস্তানের পরাজয়কে দ্রুত অনিবার্য করে তোলে। তিন দিকে ভারত আর এক দিকে বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত ভূখণ্ডে পাকিস্তান বাহিনীকে ভারতীয় স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী অবরুদ্ধ করে ফেলে। হাজার মাইল দূরে অবস্থিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তনের বিমান বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করত ভারতের আকাশসীমার ওপর দিয়ে। সে আকাশসীমাও বন্ধ করে দেয় ভারত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের রশদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আন্তর্জাতিকসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে যুদ্ধ যাতে আর দীর্ঘায়িত না হয় সে কৌশল গ্রহণ করে ভারত। তিন দিকে ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশে অবরুদ্ধ পাকিস্তান বাহিনীকে উপর্যুপরি বিমান হামলা চালিয়ে পর্যুদস্ত করে ফেলা হয়। সব বিমানঘাঁটিতে এমনভাবে বিমান হামলা চালানো হয়, পাকিস্তান বাহিনী পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় স্থলবাহিনী দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ জন্য তারা ভিন্ন একটি কৌশল অবলম্বন করেন। পাকিস্তানি বড় কোন ঘাঁটিতে আক্রমণ করে আটকা পড়ার চেয়ে তারা সব ঘাঁটি পাশ কাটিয়ে ভিন্ন পথে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে ঢাকা দখলের লক্ষ্যে। ফলে পাকিস্তান বাহিনী বুঝতে পারেনি কোন পথে আসছে ভারতীয় বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘাঁটিসংলগ্ন সড়ক অবরোধ করে বসে থাকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর অপেক্ষায়। বাংলাদেশে পাকিস্তান নৌবাহিনীকেও দুর্বল করে দেয়া হয়। পাকিস্তান সাবমেরিন গাজী ডুবিয়ে দেয়া হয় আজকের দিনে। জাহাজে ৯০ জনেরও বেশি পাকিস্তান নৌবাহিনী অফিসার ছিল।
সবাই মারা যায়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, চালনা, চাঁদপুর, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জসহ সব নৌবন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ ভেড়া অসম্ভব করে তোলা হয়। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তান বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলে হিলি, বেনাপোল, খুলনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে। মিত্রবাহিনী জীবননগর, দর্শনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ঠাকুরগাঁও, চুরখাই, গাজীপুর, শমসেরনগর, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি এলাকায় লড়াই করে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে এবং একে একে এসব অঞ্চল দখলে নেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণে একের পর এক বিভিন্ন রণাঙ্গনে দ্রুত পতন ঘটে পাকিস্তান বাহিনীর। তারা যৌথবাহিনীর ক্রমাগত ত্রিমুখী আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। দিনাজপুর জেলার সীমান্তে মুক্তিবাহিনী দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে। পাকবাহিনী হিলি ও ফুলবাড়ী রেলওয়ে দখলে রাখার জন্য মরণপণ লড়াই করে। মুক্তিবাহিনী বোদা অঞ্চল দখল করে ঠাকুরগাঁও মিত্রবাহিনীর সাথে যোগ দেয়। যশোর মহেশকুণ্ডি ও জীবননগর এবং মেহেরপুরে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর লড়াইয়ে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। বগুড়া জেলার পাঁচবিবি, ধরাদিয়া, পুশনা ও আশপাশের এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।

No comments

Powered by Blogger.