ঢাকায় ভয়ংকর চাকরির ফাঁদ

‘সিড প্রকল্প ও বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে নিজ উপজেলা ও ইউনিয়নে লোকবল নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহী বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হচ্ছে- ‘বাংলাদেশ শিশু উন্নয়ন বাস্তবায়নে শিশু বিকাশ কেন্দ্র, ১৬৭ মতিঝিল সার্কুলার রোড, ইডেন বিল্ডিং, চতুর্থ তলা।’ এভাবেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) নামে একটি চক্র চাকরি দেয়ার প্রলোভন দিচ্ছে। চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে সারা দেশের চাকরি প্রার্থী বেকার যুবকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। কেবল এই একটি চক্রই নয়। রাজধানীতে ভুয়া চাকরি দাতাদের বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। রাজধানীর আশপাশে বিশেষ করে টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকায় এ ধরনের একাধিক চক্র কাজ করছে। রাজধানীতে থাকা এ ধরনের একটি চক্রের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা হয়েছে। এদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীও রয়েছে। এরই মধ্যে এ চক্রের দুই নারীসহ পাঁচ সদস্যকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়ে যুগান্তরকে বলেছে, চাকরি প্রতারক চক্রের সদস্যরা একেক সময় একেক এনজিওর নাম ব্যবহার করে। টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর তারা গুটিয়ে নিচ্ছে অফিস। ২০৯০টি পদে নিয়োগের জন্য ভুয়া বিজ্ঞাপন দিয়ে ধরা পড়া প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্য পুলিশকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। দ্বীপক কুমার দেব নামে এক চাকরি প্রার্থীর মামলা ও ২০-২৫ জন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্র্রেক্ষিতে রাজধানীর মতিঝিল থানা পুলিশের একটি দল বৃহস্পতিবার তাদের গ্রেফতার করে। শুক্রবার তাদের আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মঞ্জুরুল আহসান খান। শুনানি শেষে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তারা হল- মাহবুবুর রহমান, সুজিত কুমার ঘোষ, রোকসানা আক্তার, মো. রবিন ও মায়া রানী রায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানিয়েছে, সর্বশেষ যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি পত্রিকায় প্রকাশ করেছিল তার মাধ্যমে এক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, অফিস নেয়ার পর তারা ওই অফিসের ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। এক মাসের মধ্যেই সব প্রক্রিয়া শেষ করে ট্রেনিংয়ের নামে জনপ্রতি ৪-৫ হাজার নেয়া হয়। এরপরই চাকরি প্রার্থীদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেয়া হয়। নিয়োগপত্রে যোগদানের তারিখ দেয়া হয় ২-৩ মাস সময় হাতে রেখে। ওই সময়ের মধ্যে নিয়োগপত্র হাতে পাওয়া চাকরি প্রার্থীদের কাছে আরও লোকবল চাওয়া হয়। তারা যেসব লোকবল দেয় তাদের কাছ থেকেও একই কায়দায় টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এরপর তারা (প্রতারক) অফিস গুটিয়ে চম্পট দেয়। গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, তাদের চক্রের প্রধানের নাম জাহাঙ্গীর আলম আকাশ। আকাশ হল গ্রেফতার রোকসানা আক্তারের স্বামী। স্বামীর সাজানো অফিসে রোকসানা রিসিপশনিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গোলাম রব্বানী যুগান্তরকে জানান, এ চক্রের সদস্যরা অনেক দিন ধরে প্রতারণা চালালেও ইডেন ভবনে তারা মাস দুয়েক আগে অফিস নেয়। এ অফিস নেয়ার পর এরই মধ্যে ৬০-৭০ চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, সর্বশেষ ১৪ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে সাতটি পদে দুই হাজারের বেশি জনবল নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয় এ চক্রের সদস্যরা। এসব পদের মধ্যে জেলা প্রোগাম অফিসার পদে ৪০, উপজেলা প্রোগ্রামার ১৫০, ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ২৫০, অফিস এক্সিকিউটিভ (নারী) ৩০০, ব্লক সুপারভাইজার ৩৫০, ইউনিয়ন সুপারভাইজার ৪০০ এবং ফিল্ড অফিসার ৬০০। এর আগে একই ধরনের পদে ৭২০ জন জনবল নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয় প্রতারক চক্রের সদস্যরা। এ চক্রের প্রধান আকাশকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মঞ্জুরুল আহসান খান বলেন, ভুয়া বিজ্ঞাপনে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত হিসেবে উল্লেখ করে। রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করা হয় সি-১১৭৭৭/১৪। প্রাথমিকভাবে ওই রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি ভুয়া বলে মনে হয়েছে। নামধারী এ প্রতিষ্ঠানের সরকারি কোনো অনুমোদনও নেই। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে বেশকিছু চাকরির আবেদনপত্র, নিয়োগপত্র ও টাকার রসিদ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা সারা দেশে নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেও ঢাকার বাইরে তাদের কোনো অফিস নেই। ঢাকায়ও তাদের কোনো স্থায়ী অফিস নেই। প্রতারণার জন্য তারা ঢাকায় অফিস নেয়। প্রতারণা শেষে ঢাকার অফিসও খুঁজে পাওয়া যায় না। মামলার বাদী দ্বীপক কুমার দে যুগান্তরকে বলেন, ‘গত ৫ মে দৈনিক প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দেখে আমি শিশু বিকাশ কেন্দ্র নামক প্রতিষ্ঠানে শাখা ব্যবস্থাপক পদে চাকরির জন্য আবেদন করি। আবেদন করার তিন দিনের মধ্যে গত ৮ মে ০১৮৪৮৩৫১৫৪৯ নম্বর থেকে মাহবুবুর রহমান নামে একজন আমাকে ফোন করে বলে- আপনাকে ১০ মে অফিসে হাজির হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। আপনার চাকরি নিশ্চিত হলে আনুষঙ্গিক খরচবাবদ আপনাকে চার হাজার ২৫০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। আমি মৌখিক পরীক্ষা দিতে গেলে আমার কাছ থেকে দ্রুত টাকা নিয়ে ওই দিনই নিয়োগপত্র দেয়। যোগদানের তারিখ দেয় ১৬ সেপ্টেম্বর। পরে তারা আমার কাছে আরও লোকবল চায়। আমি চাকরির জন্য আমার আত্মীয় রূপক দেবসহ কয়েকজনকে নিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসি। ভোর ৬টার সময় অফিস খোলা থাকা দেখে আমাদের সন্দেহ হয়। ওই সময় নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ২০-২৫ জন আমাকে জানান, তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে কিন্তু চাকরি দেয়া হয়নি। এতে সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। আমরা অফিসে গেলে চাকরি দেয়ার নামে টাকা দাবি করা হয়। আমরা বলি টাকা সঙ্গে নেই। নিচে গিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে আনার কথা বলে সোজা থানায় চলে আসি। পরে থানা থেকে পুলিশের একটি দল ইডেন ভবনে গেলে অফিসের স্টাফরা প্রথমে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পরে পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে।’ চাকরিপ্রার্থী মোরসালিন এবং তপন জানান, চাকরি দেয়ার নাম করে তাদের দু’জনসহ পরিচিত অনেকের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে। নিয়োগপত্রও দেয়া হয়েছে। কিন্তু যোগদান করতে দিচ্ছে না। চাকরিতে যোগদান করতে চাইলে অফিস থেকে বলা হচ্ছে- ‘আরও লোকজন নিয়ে আস। তাদের কাছ থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে সেখান থেকে তোমাদের কমিশন দেয়া হবে। এটাই তোমাদের চাকরি।’ ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানার গাড়াইকুটি গ্রামের জহুর উদ্দিনের ছেলে গিয়াস উদ্দিন জানান, গত রমজানে তাদের গ্রামের ১০-১২ জনকে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে গাজীপুরে আনা হয়। পরে তাদের কাছ থেকে ১০ হাজার করে টাকা নিয়ে ট্রেনিংয়ের নামে একটি অফিসে আটকে রাখে। কোনো ট্রেনিং দেয় না। এমনকি চাকরিতে যোগদানও করতে দেয় না। চাকরি চাইলে বলে- ‘তোমার পরিচিত আরও কয়েকজন লোককে খবর দাও। তাদের কাছ থেকে ১০ হাজার করে টাকা নাও। তোমাদের চার হাজার টাকা করে কমিশন দেয়া হবে। এটাই তোমাদের চাকরি।’ গিয়াস উদ্দিন আরও জানান, তিনি কৌশলে বন্দিদশা থেকে বের হয়ে এসেছেন। তার মতো আরও কয়েকজন এখনও গাজীপুরের সেই নামধারী অফিসে আটকে আছেন।

No comments

Powered by Blogger.