শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বেড়ে উঠছে সুরাইয়া

একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে চুপচাপ বসেছিল শিশু সুরাইয়া। পাশে বসে রুটি বানাচ্ছিলেন মা নাজমা বেগম। কাজের ফাঁকে বারবার সন্তানের দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন তিনি। পাছে সে পড়ে না যায়! নাজমা বেগম জানান, সুরাইয়ার শরীরের ডান পাশ খুবই দুর্বল। ডান হাত ও ডান পা ভালোভাবে কাজ করে না। পুরোপুরি অকেজো ডান চোখ ও ডান কান। এ কারণে দুই বছর পূর্ণ হলেও সে দাঁড়াতে পারে না। শুক্রবার মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ার ভূঁইয়া বাড়িতে গেলে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বহুল আলোচিত গর্ভবতী অবস্থায় গুলিবিদ্ধ সেই নাজমা বেগম। তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘প্রত্যেক শিশুর জন্মদিন তার মা-বাবার জন্য অনেক আনন্দের। ২৩ জুলাই (আগামী কাল) সুরাইয়ার জন্মদিন। কিন্তু এই দিনের কথা মনে হলে আমার চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ে। তারপরও আমার সন্তান বেঁচে আছে এটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।’ ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগম। মাগুরা সদর হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে শিশুকন্যা সুরাইয়ার জন্ম হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন নাজমা বেগম ও শিশুটি। ঘটনার দিন আহত অন্তঃসত্ত্বা নাজমার শরীরে অস্ত্রোপচার করেছিলেন মাগুরা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক শফিউর রহমান। এখনও তিনি শিশু সুরাইয়ার খোঁজখবর নেন। তিনি যুুগান্তরকে জানান, সুরাইয়ার শরীরের ডান পাশটা একেবারেই নাজুক। মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ হয়ে সে প্রাণে বেঁচে গেলেও এই প্রতিবন্ধিতা নিয়ে তাকে বেড়ে উঠতে হবে।
এর সুচিকিৎসার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বলে জানান তিনি। ডা. শফিউর আরও বলেন, গুলিটি মায়ের শরীর ভেদ করে শিশুর পিঠ, বুক, হাত, গলা এবং চোখের পাশে ক্ষত তৈরি করেছিল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে এভাবে আঘাতপাপ্ত হওয়ায় তার শরীরের ডান পাশ ভালোভাবে কাজ করছে না। তবে সুরাইয়ার সুস্থতা নিয়ে এখনও আশায় বুক বেঁধে আছেন মা নাজমা বেগম। তিনি বলেন, ‘যদি কেউ আমার মেয়ের সুচিকিৎসায় এগিয়ে আসেন তাহলে হয়তো আমার মেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরা তো টাকার অভাবে তাকে ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না।’ সেদিন যা ঘটেছিল : বিকালে ঘরের বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলেন বাচ্চু ভূঁইয়ার স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৭)। হঠাৎ বাইরে চিৎকার, চেঁচামেচি আর গুলি-বোমার শব্দ। বড় মেয়েটি ঘরের বাইরে খেলা করছে। তার কথা মনে হতেই শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও বারান্দা থেকে নেমে পড়েন। আধা পাকা টিনের ঘরের পেছনে সবজি মাচার নিচে এসে দাঁড়াতেই একটি গুলি এসে বিঁধে যায় নাজমার পেটে। তখন তার গর্ভে আট মাসের সন্তান। মারাত্মকভাবে জখম হন তিনি। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন তার চাচাশ্বশুর মোমিন ভূঁইয়া। দু’দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। অন্যদিকে মাগুরা হাসপাতালে সুরাইয়ার জন্ম হয়।
মামলার সব আসামি মুক্ত : ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে স্থানীয় যুবলীগ কর্মী মেহেদি হাসান আজিবর এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ভূঁইয়া সমর্থিত পক্ষের মধ্যে ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে নিহত মোমিন ভূঁইয়ার ছেলে রুবেল ভূঁইয়া বাদী হয়ে জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সহসভাপতি সুমন সেনসহ ১৭ জনকে আসামি করে মাগুরা থানায় একটি মামলা করেন। ওই বছরের ১৮ আগস্ট মামলার প্রধান আসামি যুবলীগ কর্মী পুলিশের ক্রসফায়ারে মারা যায়। অন্যদিকে অভিযুক্ত সব আসামিকে আটক করা হলেও মামলাটি চলছে এখন ধীরগতিতে। মাগুরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আরাফাত হোসেন ২৮ মার্চ মামলাটির চার্জ গঠন করেন। কিন্তু চার্জ গঠনের পর এখন পর্যন্ত বাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন না হওয়ায় মামলাটি শুরুতেই থেমে আছে। অন্যদিকে অভিযুক্ত আসামিদের সবাই একে একে জামিনে মুক্ত হয়ে গেছে। মামলার সরকার পক্ষের আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে দু’বার বাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছিল। সর্বশেষ তারিখ ছিল ২০ জুন। কিন্তু মামলার বাদী রুবেল ভূঁইয়া সময়মতো আদালতে হাজির না হওয়ায় সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি। আগামী ৮ আগস্ট রুবেল ভূঁইয়ার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আদালত নতুন দিন ধার্য করেছেন বলে তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.