কষ্ট সয়েও নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা

স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উদযাপন করতে শেকড়ের টানে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ। জনস্রোত এখন বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ঘাট আর রেলস্টেশনের দিকে। স্বভাবতই সড়ক, রেল ও নৌপথে ঠাঁই নেই কোথাও। প্রতিবারের মতো এবারও সঠিক সময়ে বাস না ছাড়া, পরিবহন সংকট, টিকিটের উচ্চমূল্য, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল, যানজট, অতিরিক্ত যাত্রী বহনসহ হাজারও কষ্ট ভোগ করছেন ঘরমুখো মানুষ।
যানজটের আশঙ্কা ১৪ পয়েন্টে
ঈদে ঘরমুখো মানুষের অন্যতম একটি ভোগান্তির কারণ যানজট। এবারের ঈদ যাত্রায় দেশের ১৪ পয়েন্টে যানজটের আশঙ্কা করছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, সড়ক ও মহাসড়ক অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বড় ধরনের যানজটের সৃষ্টি হয় মূলত ৪টি এলাকায়। এগুলো হল- ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক, জয়দেবপুর চৌরাস্তা, যমুনা সেতুর পূর্ব স্টেশন ও আশুলিয়া। পাশাপাশি ঢাকার ভেতরে ১০টি পয়েন্টে যানজট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এগুলো হল- আশুলিয়ার জিরাবো বাজার, ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে, বাইপাইল মোড়, চন্দ্রা মোড়, কোনাবাড়ি, কালিয়াকৈর, নবীনগর, কাঁচপুর, ভুলতা ও মেঘনা। মালিক সমিতির নেতা ও পরিবহন চালকরা বলছেন, প্রতিবারের মতো এবারও ভোগান্তির কারণ হতে পারে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক। মে মাসের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় প্রতিদিনই এই মহাসড়কে যানজট আছে। সর্বোচ্চ প্রায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছাড়িয়েছে যানজটের পরিধি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ ফোর লেন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। টাঙ্গাইলের ফোর লেন প্রকল্পের কাজ চলমান। সিলেটের অবস্থা মোটামুটি ভালো। জানা গেছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কে গাড়ির চাপ তুলনামূলকভাবে বেশি। কিছু কিছু স্থানে ভাঙাচোরা সড়ক, নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, হাটবাজার, স্বল্প গতির যানবাহন, লোকাল গাড়ির আধিক্য, অবৈধ পার্কিং ও বাজারসহ নানা কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল আড়াই ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে সময় লাগছে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা। যমুনা সেতুর পূর্ব স্টেশন থেকে কালিহাতী উপজেলা এবং মির্জাপুর এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে মির্জাপুরের ইচাইল, ডুবাইল, মিয়াপুর ওম সোহাগপাড়া, কালিহাতীর চরভাবনা, বাসাইলের বাইখোলা, ঘাটাইলের কালিদাসপাড়া এবং সদর উপজেলার করটিয়া দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা এবারও দুশ্চিন্তার কারণ। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ভোগড়া বাইপাস হল যানজটের দিক থেকে বিষফোঁড়া। আবার জয়দেবপুর চৌরাস্তার সমস্যাও তেমনি। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া গাড়িগুলো জয়দেবপুর চৌরাস্তার তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার আগে থেকেই যানজটে পড়ে।
চাকু পার্টি ও টানা পার্টি
রমজানে সন্ধ্যা নামলেই রাজধানী জুড়ে ছিনতাই আতঙ্ক বাড়ছে। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত চলে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। বিশেষ করে, রাত আটটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এবং সেহরির সময় থেকে সকাল পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বাড়ে। রোববার সন্ধ্যায় রিপন নামে এক মিডিয়াকর্মী রাজধানীতে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। জানা গেছে, সহকর্মীর সঙ্গে রিকশাযোগে ধানমণ্ডি যাওয়ার সময় মোটরসাইকেল আরোহী ছিনতাইকারীরা টান দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে গেছে। ব্যাগে টাকা, মোবাইলসহ দরকারি মালামাল ছিল। একই সময় মিরপুরেও এক মহিলার হ্যান্ডব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। রমজানের চতুর্থ দিন ভোরে পুরনো ঢাকার ধলপুরে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলমকে ছিনতাইকারীরা কুপিয়ে হত্যা করে। একইদিন সদরঘাটে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে এক লাখ টাকা হারান কাপড় ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন। এসব ঘটনার দু’দিন পর পল্টনের দৈনিক সংবাদ অফিসের পাশে গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টির পর এক ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। গত বুধবার রাতে পৃথক ঘটনায় এক ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিক এসএম আবুল হোসেন এবং ফজলুর রহমানসহ তিনজন ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। জানা গেছে, রমজানে প্রতিদিন রাজধানীতে অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। শুধু বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটলেই বিষয়টি জানাজানি হয়। ডিএমপি উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ঈদকে সামনে রেখে ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে আমরা তৎপর রয়েছি। আগের চেয়ে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে, নিয়মিত চেকপোস্ট বসছে। বিভিন্ন বিপণিবিতানে ও মোড়ে মোড়ে পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
তৎপর অজ্ঞান পার্টি
ঈদকে ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অজ্ঞানপার্টি আর মলমপার্টি। প্রতিনিয়তই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে অজ্ঞান পার্টির একাধিক চক্রকে গ্রেফতার করেছেন। পুলিশের তথ্য মতে, শুধু রাজধানীতেই এই চক্রের অসংখ্য গ্রুপ নানাভাবে সক্রিয়। বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেলস্টেশনে ওঁৎ পেতে থাকা অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সুযোগ পেলেই কৌশলে অচেতন করে লুটে নিচ্ছে নগদ টাকা ও মালামাল। অচেতন করার কাজে তারা এমন সব কেমিক্যাল ব্যবহার করছে যাতে থাকছে মৃত্যুঝুঁকি। বুধবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ২১ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র, নেশা জাতীয় সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন জানান, বুধবার রাতে ডিএমপির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ বিশেষ অভিযান চালিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকা থেকে অজ্ঞান পার্টির ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে। অন্যদিকে কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাই ও ডাকাত চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানায়, চেতনানাশক ট্যাবলেট বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য যেমন ডাবের পানি, খেজুর, চা, কফি ও তরল দ্রব্যের সঙ্গে মিশিয়ে তারা নিজেদের হেফাজতে সংরক্ষণ করে। অনেক সময় এরা যাত্রী কিংবা হকারের বেশে বিভিন্ন গণপরিবহনে উঠেন। তাছাড়া বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালসহ জনসমাগমস্থলে নিরীহ যাত্রী বা পথচারীদের মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট করে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। সখ্যের এক পর্যায়ে তাদের আগের প্রস্তুতকৃত খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে চেতনানাশক ট্যাবলেট মিশ্রিত খাবার টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কৌশলে খাইয়ে অচেতন করে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান দ্রব্যসহ সব লুটে নিয়ে পালিয়ে যায়।
নারী ছিনতাইকারী হতে সাবধান
ঈদকে সামনে রেখে নতুন পদ্ধতিতে তৎপর হয়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ মহিলা ছিনতাইকারী চক্র। কিছুদিন আগে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেলাল হোসেন একটি শপিংমল থেকে কেনাকাটা শেষে ফেরার পথে একজন মহিলার খপ্পরে পড়ে সবকিছু হারান। জানা গেছে, ছদ্মবেশি ওই মহিলা প্রথমে বেলাল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে ভাব জমান। পরে বেলাল সাহেবকে অনুরোধ করেন তার যাত্রা পথে তাকে যেন নামিয়ে দেন। এরপর একটি রিকশায় ওঠেন তারা। মাঝপথে রিকশা একটু অন্ধকার রাস্তায় গেলে চিৎকার করার হুমকি দেন ওই মহিলা। মহিলা চিৎকার করে বলতে থাকেন, সঙ্গে যা আছে সব দিয়ে দে। না হলে চিল্লাবো তুই আমার সঙ্গে নষ্টামি করছো। আশেপাশে থাকা কয়েকজনকে দেখিয়ে বলেন, এরা সবাই আমার লোক। টাকা পয়সা যা আছে দিয়ে দে নাহলে, তোর মান-সম্মানও খাবো মাইরও খাবি। বাধ্য হয়ে বেলাল সাহেব সব দিয়ে দেন। পকেটের সাত হাজার টাকার সঙ্গে শপিংয়ের সব মালামাল দিতে বাধ্য হন তিনি। এটাই রাজধানীতে প্রতারণা করে ছিনতাই করা সর্বশেষ কৌশল। বিভিন্ন বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন, শপিংমলসহ মার্কেটগুলো এসব মহিলা ছিনতাইকারীরা তৎপর। ছদ্মবেশী এসব মহিলারা প্রথমে সজহ-সরল এবং বৃত্তশালী লোকদের টার্গেট করেন। এরপর কোনভাবে ভাব জমিয়ে সর্বস্ব লুটে নেন। এক্ষেত্রে ছিনতাইকারী মহিলার সঙ্গে বড় ধরণের একটি চক্র কাজ করে।
মহাসড়কে মৃত্যুফাঁদ
জমাটবাঁধা রক্ত আর স্বজনের চোখের নোনাজলে রাজপথ ভেজে প্রতিনিয়ত। বিগত দুই বছরে ঈদুল ফিতরের আগে ও পরের ৭ দিনেও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় কয়েকশ’ মানুষ। দেশের সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪ শতাংশ ঘটে দুই বা ততধিক যানবাহনের সংঘর্ষে। যার মধ্যে ১৭ শতাংশই মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহনের ২৮ শতাংশই যাত্রীবাহী বাস। সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। চালকদের ভুলের কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। আরেকটি সংস্থা বলছে, বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৫ হাজার মানুষ। নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন যুগোপযোগী সড়ক আইন। কিন্তু ২০১২ সালে সড়ক আইন পাস করার সুপারিশ করা হলেও এখনও সেটি পাস করা হয়নি।
নৌপথেও ভোগান্তি
সপ্তাহ খানেক পরেই ঈদ। ভিড় বাড়ছে লঞ্চ টার্মিনালে। ঈদকে সামনে রেখে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ নামানোর উদ্যোগ নিচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু লঞ্চ মালিক সিন্ডিকেট। অতিরিক্ত যাত্রী আনানেয়ার ভিড় সামলাতে এসব লঞ্চ ঈদের ঠিক ৪/৫ দিন আগ থেকে চলাচল শুরু করবে বলে জানা গেছে। তবে লঞ্চ মালিক সমিতির দাবি, এসব লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে, কোনোটাই ঝুঁকিপূর্ণ নয়। নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, সুষ্ঠু নৌ চলাচল এবং যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে সরকার সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

No comments

Powered by Blogger.