পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের পর

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় পাহাড় ধসের যে ঘটনা ঘটেছে তাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে সরকারি মহল থেকে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলেও আসলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই তা ঘটেনি। এটা ঠিক যে, টানা দু-তিনদিন জোর বৃষ্টির পর এ ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বৃষ্টি হলেই এমন হওয়ার কথা নয়। এটা আগে কখনও হয়নি, যদিও এ মাত্রায় বৃষ্টি পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন নয়। বৃষ্টি হলেই পাহাড়ে ধস নামে না। সেটা হলে এতদিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় বলে আর কিছু থাকত না। শত শত বছরের বৃষ্টিতে সেগুলো মাটিতে মিশে যেত। কিন্তু এতদিন যা হয়নি, এখন তা-ই হচ্ছে। এই বিপর্যয় ঘটেছে দুর্বৃত্তদের চুরি, লুটপাট, পাহাড় ও ভূমি দখল, বন উজাড় ইত্যাদি কারণে। পাকিস্তানিরা এ দেশ থেকে অনেক কিছু লুণ্ঠন করেছে, কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ একমাত্র স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকারীর দাবিদাররা স্বাধীন বাংলাদেশে এখন দেশ, জনগণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের এমন সর্বনাশ করেছে, যার মতো অপরাধ এর আগে কেউ করেনি। এ দুর্বৃত্তরা যেভাবে ১৯৭২ সাল থেকে এ দেশ শাসন-শোষণ করে এসেছে তার পরিণতিতে এখন সরকারি সহায়তায়, সরকারের ছত্রছায়ায় এবং খোদ সরকারি লোকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে স্বাধীন বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে স্বাধীন অপরাধীদের স্বর্গভূমিতে। তারা ব্যাংক ডাকাতি, ভূমিদস্যুতা, নদী দখল ও দূষণ, উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ-দুর্নীতি থেকে নিয়ে বনভূমি পর্যন্ত লুটপাট করে দেশে নানা ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ধসের ঘটনাকে এই পরিস্থিতি থেকে আলাদা করে দেখার প্রশ্ন ওঠে না।
লন্ডনে একটি ২৭ তলা বিল্ডিংয়ে আগুন লেগে কয়েকদিন আগে বহু লোকের মৃত্যু হয়েছে। বহু লোক আহত অবস্থায় হাসপাতালে আছে। এ দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে শোক প্রকাশ করা ছাড়াও নিজে গিয়ে সেখানে পরিস্থিতি দেখেছেন এবং উদ্ধার কাজ ও আশ্রয় কেন্দ্রের ব্যবস্থা তদারক করেছেন। রানী এলিজাবেথ শোক প্রকাশ করা ছাড়াও নিজে ঘটনাস্থলে গিয়ে আশ্রয় শিবিরে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সরকার ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীর দল সাধারণ মানুষ, গরিব লোক এবং বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে মানুষই মনে করে না। মন্ত্রী সেখানে গিয়ে অনেক লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা সত্ত্বেও সেখানকার অবস্থা ভয়াবহ। এই হল বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রধান শাসক দল, যারা এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তাদের অবস্থা। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধসের ফলে দেড় শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। শুধু রাঙ্গামাটিতেই মৃত্যুর সংখ্যা একশ’র বেশি। এ ছাড়া আহতদের সংখ্যাও অনেক। হাজার হাজার মানুষ এর ফলে গৃহহীন হয়ে আশ্রয় ও খাদ্য-পানীয়ের অভাবে, জ্বালানির অভাবে হাহাকার করছে। অথচ সরকারের সেদিকে ভালোভাবে দৃষ্টি দেয়ার কোনো ব্যাপার নেই। পাহাড় ধসের ফলে সড়কপথ অচল হয়েছে, এই অজুহাতে সেখানে প্রয়োজনীয় ত্রাণ পাঠানো ঠিকমতো সম্ভব হচ্ছে না, এই মর্মে তারা কেউ কেউ বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। সড়কপথ অচল হওয়ায় নদীপথে ধীর গতিতে সেখানে কিছু ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ব্যবস্থা তারা করছেন যা মোটেই যথেষ্ট নয়। কিন্তু সড়ক ও নদীপথের এ অবস্থা হলেও ত্রাণ পাঠানোর অন্য ব্যবস্থাও তো আছে। এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টারে ত্রাণ অবশ্যই পাঠানো যায়। হেলিকপ্টার সেখানে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে নামতে পারে, বিমান থেকে সাহায্যসামগ্রী নিচে ফেলা যায়। কিন্তু তার কিছুই হচ্ছে না। কারণ এ সরকারের দৃষ্টিতে সেখানকার মানুষ মনুষ্য পদবাচ্য নয়! তারা পাহাড়ি মাত্র!! বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও তাদের সরকার আজ দেশে কী ধরনের বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছে, এর থেকে তার বড় প্রমাণ আর কী আছে?
এ কথা ওয়াকেবহাল মহলে সবাই জানে যে, দুর্বৃত্তরা সরকারি বনবিভাগের কর্মচারীদের সহায়তায় পাহাড় ও বনাঞ্চলে গাছ কেটে শেষ করতে থাকার কারণেই সেখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য সব দিক দিয়ে নষ্ট হয়েছে এবং তার ফলে সেখানে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে পাহাড় ধস একটি। ১৮ জুন প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম খবর হিসেবে দৈনিক প্রথম আলো ‘বন উজাড় ও পাহাড় কাটার কারণেই ধস’ শিরোনামে এক রিপোর্ট ছেপেছে। তাতে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এক-চতুর্থাংশ বনভূমি ধ্বংস হয়েছে, ৬১ শতাংশ ঝরনা শুকিয়ে গেছে, ভূতাত্ত্বিক গঠন নষ্ট করে সড়ক নির্মাণ এবং পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ধ্বংসাত্মক কাজ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনই করে চলেছে। সরকারের নাকের ডগাতেই এসব হচ্ছে। এ কারণে দেশের জনগণের ও প্রকৃতির এই সর্বনাশ হতে থাকলেও সরকারের সেদিকে দৃষ্টিপাতের কোনো ব্যাপার নেই। এ দুর্বৃত্তদের প্রতিপালন করে ও কাজে লাগিয়েই আজ সরকার নিজের গদি রক্ষা করছে এবং দেশে নানা ধরনের সংকট তৈরি করেও মোটামুটি নিরাপদ আছে। এ ধরনের সরকার দুনিয়ার অন্য কোথাও আছে এমন দেখা যায় না। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ স্বত্বাধিকারীরা স্বাধীন বাংলাদেশকে এ অবস্থায় এনে দাঁড় করাবে, এটা পাকিস্তানবিরোধী সংগ্রাম এবং বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সময় কে জানত? বাংলাদেশের এ অবস্থা দেখে মনে হয় আকাশ ভেঙে মাটিতে পড়েনি, একেবারে পাতালে প্রবেশ করেছে। সব কিছু দাঁড়িয়ে আছে মাথার উপর। অথচ প্রতিদিন সরকারি লোকদের বাচালতা এবং দায়িত্বহীন ও বেপরোয়া কথাবার্তা, যা সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রকাশিত হয়, থেকে মনে হয়, বাংলাদেশের জনগণ এখন সুখ-শান্তিতে জীবনযাপন করে স্বর্গে বাস করছে! এটাই যে দেশের ও জনগণের জীবনের প্রকৃত অবস্থা, তারই প্রমাণ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধস এবং পরবর্তী সময়ে সরকারের আচরণ।
১৮.০৬.২০১৭
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.