ড্রামা নয়, রাজনৈতিক বাস্তবতা

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৪ শরিক নিয়ে সম্মিলিত জাতীয় জোট (ইউএনএ) নামে একটি জোট গঠন করেছেন। এই জোটে রয়েছে দুটি নিবন্ধিত দল- জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট এবং ২টি জোট ‘জাতীয় ইসলামী মহাজোট’ আর ‘বাংলাদেশ জাতীয় জোট’ (বিএনএ)। এর মধ্যে জাতীয় ইসলামী মহাজোটে অন্তর্ভুক্ত আছে ৩৪টি ইসলামী দল এবং বিএনএ-তে আছে ২২টি রাজনৈতিক দল। জোটের সমন্বয়ে জোট হল কেন- তার ব্যাখ্যা এই যে, সম্মিলিত জাতীয় জোট গঠনের জন্য দু’ভাবে শরিক নির্বাচনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এক. যেসব দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত আছে, সেই দল সরাসরি শরিক হিসেবে থাকবে এবং দুই. যেসব দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে কিংবা নিবন্ধিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে তাদের সমন্বয়ে মোর্চা বা জোট গঠন করে সেই জোটকে শরিক হিসেবে বৃহত্তর জোটে অন্তর্ভুক্ত করা। এইভাবে দুটি পৃথক জোট এবং দুটি নিবন্ধিত দল নিয়ে- অর্থাৎ ৪ শরিক নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোট গঠিত হয়েছে। জোটের সমন্বয়ে জোট করা হয়েছে, তাই এই জোটের নাম সম্মিলিত জাতীয় জোট। এখানে দুই শরিক জোটের সব দলের হয়তো নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা নেই, তাই তাদের জনপ্রিয়তা নিরূপণের মাপকাঠিও নেই। কিন্তু এর মধ্যে প্রায় সব দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে এবং কোনো কোনো দল নিবন্ধন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। যেসব দল নিবন্ধন পাওয়ার জন্য আবেদন করে, সেই সব দলকে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ করে আবেদন করতে হয়েছে। যেসব দলের এখন নিবন্ধন আছে, তাদেরও একসময় নিবন্ধন ছিল না। সুতরাং এখন পর্যন্ত যেসব দলের নিবন্ধন হয়নি, সেসব দলকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
এখন পর্যন্ত ৪ শরিকের সম্মিলিত জাতীয় জোটে মোট ৫৮টি দল রয়েছে। তবে আরও নিবন্ধিত দল এবং জোট এ জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এ জোটকে বিএনপির মহাসচিব মহোদয় নতুন ড্রামা বলেছেন। এখানে নাকি দু-একটি দল ছাড়া আর কোনো দলের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এ কথার প্রত্যুত্তরে বলতেই হয় যে, তাদের নেতৃত্বে ২০ দল নামের যে জোট আছে, সেটি একটি অপেরা। এই অপেরা দলে কার কতটুকু অস্তিত্ব আছে, একটু নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই বিবেচনা করুন। কথায় আছে- ‘চালনি বলে সূঁচ তোর গায়ে একটা ফুটা।’ ২০ দলীয় জোটের সব দলের নাম আমার জানা নেই। ক’জনের জানা আছে- তাও জানি না। তবে জাতীয় পার্টিতে পদ না পেয়ে কিংবা জাতীয় পার্টি থেকে বাদ পড়ে কেউ কেউ দল করেছেন- এমন সংখ্যা কম করে হলেও হাফ ডজন। তারা গিয়ে যুক্ত হয়েছেন ২০ দলীয় জোটে। তারা আবার ওখানে গিয়ে ৩ জনের দল দুই ভাগ হয়ে জোটের শরিক সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কোনো জোটে, এরকম অস্তিত্বওয়ালা শরিক আছে বলে আমার জানা নেই। এ দেশে জোট গঠনের রাজনীতি নতুন নয়। শুরু হয়েছে সেই ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৫ দল, ৭ দল, ৫ দল, ৪ দল এবং মহাজোট গঠনের কথা আমরা জানি। চারদলীয় জোট গঠনের যৌথ ঘোষণাপত্র এবং মহাজোট গঠনের যৌথ ঘোষণাপত্রের কপিও আমার সংরক্ষণে আছে। সহকর্মী কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বলেছেন, জোটের ভবিষ্যৎ কী হবে কিংবা কী অর্জন আছে, জানি না, তবে ঘোষণাপত্রটি হয়েছে চমৎকার। আমরা বলতে চাই- ভবিষ্যতের কথা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। কী অর্জন আছে কিংবা কী অর্জন হবে, তাও সময় বলে দেবে। তবে আমার ব্যক্তিগত একটা অর্জন আছে, সে কথা আমি পরিশেষে বলতে চাই। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে যে সম্মিলিত জাতীয় জোট গঠিত হয়েছে- এটা একটা বহুমাত্রিক জোট।
এখানে ইসলামী দল, পীর মাশায়েখ আদর্শিত দল, হিন্দু সংগঠন, সাধারণ রাজনৈতিক দল, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ, ইসলামী মূল্যবোধ এবং সব ধর্মের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শিক দল এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী শক্তির সমন্বয় ঘটেছে। এ জোটের ঘোষণাপত্রে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবার নীতি ও আদর্শের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে, যা ৪টি শরিক তথা ৫৮টি দলের কাছে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এই কাজটি সম্পন্ন করা সহজ ছিল না। এই জোটের ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎই বলুক। তবে, যাত্রাই শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনার মধ্য দিয়ে। বিগত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে- জোট গঠন নিয়ে অতীতে এত আলোচনা আর কখনও হয়নি। এই আলোচনার ঝড় উঠেছে মিডিয়া জগৎ থেকে শুরু করে গোটা দেশে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে একটি জাতীয় জোট গঠিত হওয়ায় যাদের আঁতে ঘা লেগেছে, তারা আঁতকে ওঠে আবোলতাবোল বলছেন। যারা এ জোট নিয়ে আশার আলো দেখছেন, তারা উল্লসিত হয়েছেন। ফলে এখানে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যাদের বিরোধিতা করার স্বভাব, তারা বিরোধিতা করবেন, সেটাই মানতে হবে। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী ঐক্য গড়ে উঠলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে- সেটা রাজনৈতিক সচেতন সবাই বুঝবেন, মির্জা সাহেবরা বুঝবেন না কেন? জোট ঘোষণার দিনে একটা টিভি চ্যানেলে গিয়েছিলাম। সেখানে মুখোমুখি হলাম বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ড. জাফরুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বললেন, এ জোট গঠনে জাতীয় পার্টির কোনো লাভই হবে না। জাতীয় পার্টির একলা থাকাই ভালো। এটা তাদের সুবিধার কথা। বানরের কলা ভাগের মতো- নিজের ভাগেই সব।
তার বক্তব্য- এটা প্রধানমন্ত্রী আর ‘র’-এর কথায় গঠন করা হয়েছে। বললাম, জাফরুল্লাহ সাহেবের কথা শুনে মনে হল- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নির্দেশটা যেন ওনার মাধ্যমেই জাতীয় পার্টির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন! দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা সম্পর্কে মিডিয়ায় ড. জাফরুল্লাহ যে মিথ্যাচার করেছেন, তার জন্য আইনের আশ্রয় গ্রহণ করলে আবার তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। জোট গঠনের ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির ভাগ্য বৃহস্পতির অবস্থানে। জাতীয় পার্টি মৌলিকভাবে গড়ে ওঠেনি- উঠেছে যৌগিকভাবে। অর্থাৎ অনেক দলের সংমিশ্রণে। কয়েকটি দলের ঐক্যে হয়েছে জনদল। সেই জনদল থেকে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, ডেমোক্রেটিক লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, মুসলিম লীগ এবং বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতাকর্মীদের সংমিশ্রণে জাতীয় পার্টি গঠিত হয়েছে। মূলত জাতীয় পার্টি একটি জোটগত সংগঠনের একক রূপ। এখানে বিভিন্ন দল ও মতের রাজনীতিকদের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। এই নীতি ও আদর্শ জাতীয় পার্টির সামগ্রিক রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৫ দলীয় জোট গঠন করে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ২২ বছর পর তারা ক্ষমতায় গেছে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে। সেটাও ছিল ঐক্য প্রক্রিয়ার একটি অংশ। সেই ঐক্য ভেঙে দেয়া হয়েছিল বলেই পরেরবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারেনি। তারপর জাতীয় পার্টিকে নিয়ে হয়েছিল চারদলীয় জোট। এ জোটের পক্ষে এমন জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল যে, বিশাল জয় নিয়ে জোটপ্রধান বিএনপি ক্ষমতায় চলে যায়। কিন্তু প্রতারণা করা হয়েছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে। ফলে পরবর্তীকালে গঠিত হয় মহাজোট।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি যোগ দেয়ায় ১৫ দলীয় জোট হয়নি, হয়েছে মহাজোট। সেই মহাজোটের জোয়ারে আওয়ামী লীগ আজও ক্ষমতায় আছে। আর ভেসে গেছে বিএনপি। তাই জোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি একটি সৌভাগ্যের প্রতীক। এই প্রতীকের ললাটেই লেখা থাকবে- ক্ষমতার ভবিষ্যৎ। বলেছিলাম, এই জোট গঠন প্রক্রিয়ায় আমার একটা বড় অর্জন আছে। জোট গঠনে আমি সমন্বয়কের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। সেই সুবাদে প্রতিটি দলের নেতাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছে। তার মধ্যে ইসলামী দলই বেশি। তাদের নেতাদের প্রায় সবাই ওলামায়েকেরাম, ধর্মীয় নেতা, পীর-মাশায়েখ। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে না মিশলে হয়তো তাদের সঠিকভাবে চেনার ক্ষেত্রে একটা ঘাটতি আমার থেকে যেত। তথাকথিত কিছু প্রগতিবাদী তাদের মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করেন, কেউ কেউ তাদের সাম্প্রদায়িক বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু তারা ভুল করেন, ভুল বলেন। এই ধর্মীয় নেতাদের কেউ-ই নেতিবাচক অর্থের মৌলবাদী নন। তারা সাম্প্রদায়িকও নন। নিজ ধর্মের প্রতি সর্বতোভাবে তারা অনুগত, ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনে তারা সম্পূর্ণ নিবেদিত এবং ধর্মের সামান্যতম অবমাননা তারা কোনোভাবেই মানেন না- এটাই তাদের মৌলনীতি। এই ধর্মীয় নেতারা অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি লালবাগ শাহী মসজিদে গিয়েছি- সাত মসজিদ মাদ্রাসায় গিয়েছি- আলেম-ওলামাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। তাদের আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি হিন্দু বলে আমাকে অন্য চোখে দেখেননি। আমার মধ্যস্থতায় ইসলামী দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টির ঐক্য হচ্ছে, তা নিয়ে তাদের কারও মধ্যেই এতটুকু মাথাব্যথা ছিল না। তারা সবাই আমাকে বিশ্বাস করেছেন- অকৃত্রিমভাবে। এটাই আমার বিশাল অর্জন।
সুনীল শুভরায় : লেখক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.