এ সমাজ কবে অভয়ারণ্য হবে?

লেখাটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। রিশা হত্যাকাণ্ড ইয়াসমিন থেকে শুরু করে তনু হত্যার ধারাবাহিকতা মাত্র, বিরোধিতা করার কোনো উপায় আছে কি? মোটেও নেই। এ দেশে সুসজ্জিত আইন আছে, প্রশাসন আছে, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, সুশীলসমাজ আছে, জাগ্রত চেতনার রাজনীতিক আছে, নেই কেবল দায়বদ্ধতা। নেই ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থের ঊর্ধ্বে অবস্থান। আর সে কারণেই ইয়াসমিন, তনু, রিশারা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়, তাদের এ জগৎ ছেড়ে যেতে হয়। রিশা এমন এক সময়ে দিনে-দুপুরে জনসম্মুখে বখাটের চাপাতির আঘাতে মৃত্যুবরণ করল, যখন গত পাঁচ মাসেও তনু হত্যার কারণ উদঘাটন করতে পারেনি মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। পারেনি তনুর পোশাক থেকে ধর্ষণের আলামতসহ যে তিনজন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া গেছে, তা সন্দেহভাজন কারও সঙ্গে মেলাতে, তনুর মা সন্দেহভাজনদের নাম বলার পরও! কী আজব দেশ! এ কালক্ষেপণ, ধীরগতিই বলে দিতে পারে আগামীতে আমাদের দেশে, সমাজে আর কোনো কিশোরী, তরুণী, নারী ধর্ষিত হবে কিনা, নিমর্মভাবে মৃত্যুবরণ করবে কিনা কিংবা এ তালিকা কত লম্বা হবে। এর জবাব কিন্তু আমরা তনু হত্যার পাঁচ মাস পরেই পেয়ে গেলাম। একজন তেরো-চৌদ্দ বছরের শিক্ষার্থী রিশা তনুদের তালিকাভুক্ত হল। কিন্তু কঠিন ও মর্মান্তিক সত্য হল, এ উত্তর কেউ সহজে খোঁজে না, খুঁজতে চায় না। এ উত্তর না খোঁজার পেছনে যেমন স্বার্থগত কারণ আছে, নৈতিক অবক্ষয় আছে, তেমনি আছে ভয়। ভয়টা হয়রানির, যার ধরন,
মাত্রা ও দীর্ঘসূত্রতা ভয়াবহ। অপরাধী প্রভাবশালী ও প্রতাপশালী হলে অপরাধের সাক্ষী থাকে না। কিংবা থাকলেও ভয়ে তারা নিষ্ক্রিয় থাকে। আবার এসব ক্ষেত্রে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে কাউকে কোনো কোনো সময়ে উপরের আদেশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকতে হয়। এসব হয় অপরাধী ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায়। না বলে উপায় নেই, একটি দেশে যখন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ সংস্থাটিকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তখন সংস্থার পবিত্র আদর্শ, উদ্দেশ্য বলে আর কিছু থাকে না, রাখা যায় না। আর তখনই আইনশৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। জনগণের নিরাপত্তাহীনতা তখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ হয় দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে, নয় জাতির স্বার্থে। জাতির স্বার্থ নয়, দলীয় স্বার্থই তখন বড় হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে আইনি সহায়তা চাইতেও ভয় পায়, তারা পুলিশবিমুখ হয়। আবার পুলিশের অহেতুক ঘুষ প্রার্থনা ও দীর্ঘসূত্রতায় সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় অনেক সময়। সবচেয়ে মর্মান্তিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যখন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমন দৃষ্টান্ত যেমন আছে,
তেমনি এ দৃষ্টান্তও আছে যে এদের বিচারের আওতায় আনা যায় না সহজে। ফলে সমাজে নারী ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা সহজ ও মামুলি ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। বিচারহীনতার কারণেও অনেকে এমন অপরাধে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে যখন-তখন। তনু হত্যার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও ধীরগতি আজ রিশা হত্যার নেপথ্যে প্রশ্রয় হিসেবে কাজ করেছে বা ভূমিকা রেখেছে বললে অযৌক্তিক হবে কি? রিশা হত্যার বিষয়টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, নারী নির্যাতন ঘটনার ধারাবাহিকতা মাত্র। বলতেই হয়, এ ধারাবাহিকতা বজায় আছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা, বিচারহীনতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক উদাসীনতা, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। দেশে কোনো রাজনৈতিক দলের উল্লেখ করার মতো এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই যে তারা নারী নির্যাতনের ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে, পরিস্থিতি বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চার, প্রতিবাদী হয়েছে নির্যাতিত নারীর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সমগোত্রীয় সদস্য, মানবাধিকার সংগঠন ও সাধারণ মানুষ। রিশা দিনে-দুপুরে নিজ স্কুলের সামনে জনসম্মুখে হামলার শিকার হয়েছে। তার আর্তচিৎকারে কেউ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। এটি বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তার দুর্বল দিকটিই তুলে ধরে। সাধারণ মানুষের দায় এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে। কারও উপকার করতে যেয়ে বিদ্যমান আইনি প্রক্রিয়ায় হয়রানির শিকার হওয়ার আশংকাও এর একটি কারণ, যা আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি সর্বসাধারণের অনাস্থার কথা বলে।
আজ যদি এ ধরনের অপরাধীদের প্রতিরোধে জনগণ এগিয়ে আসত, তাহলে রিশার মতো কেউ জনসম্মুখে এভাবে নৃশংস হত্যার শিকার হতো না। এ ধরনের অপরাধ ঘটাতে অপরাধীর ভেতর একটা ভয় কাজ করত। জনসম্মুখে এ ধরনের অপরাধ ঘটানো হলি আর্টিজানের বর্বরতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কারও উপকার করতে গিয়ে বিদ্যমান আইনি প্রক্রিয়ায় হয়রানির শিকার হওয়ার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে সাধারণ মানুষের। ফলে নিজের খেয়ে মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করছে। এটা স্পষ্ট যে, সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতে ‘পুলিশি হয়রানি’র ভয়ও বাধা হিসেবে কাজ করছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থাকে এ বিষয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। আইনি ও বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি; যা সম্ভব কেবল রাজনৈতিক উদ্যোগ ও সততার মাধ্যমে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অপরাধীর দোষ যে লঘু করে দেয়, এমন দৃষ্টান্ত কম নেই। সুতরাং আইনকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে চলতে দেয়া জরুরি। তাহলে রিশার মতো কিশোরীকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন অনেকেই। রিশা ও তনুর মতো কাউকে নির্মম হত্যা করার দুঃসাহস দেখাবে না কেউই। পরিশেষে বলব, নারী-শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ পথেঘাটে, সভা-সেমিনারে এতদিন সাধারণ মানুষ করেছে। এবার অন্তত একবার সরকার করুক, তার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়।
স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.