প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার অভাবে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটছে

ইসলামিক স্টেটের ফাঁস হওয়া নথি এবং সংস্থাটির পুরনো কিছু সদস্যের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রণীত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগদানকারী ৭০ শতাংশ সদস্যই ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখে না। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ২৪ শতাংশ আইএস সদস্যের ইসলাম সম্পর্কে ধারণা বা জ্ঞান মধ্যম পর্যায়ের। তাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ পবিত্র কোরআনে হাফেজ। মূলত ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকার কারণে তাদের খুব সহজে ইসলামের কথা বলে বিভ্রান্ত করা যায়। উঠতি বয়সের তরুণরা সাধারণত এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চারিজমে আচ্ছন্ন থাকে। ফলে তাদের ইসলামের কথা বলে সহজেই উগ্রবাদে দীক্ষিত করা যায়। ‘মরলে শহীদ আর বাঁচলে গাজি’ এ ধরনের রোমান্টিকতায় তাদের আপ্লুত করা হয়। কিন্তু প্রকৃত শহীদ কারা, বা কী কী শর্ত পূরণ করলে একজন মানুষ শহীদ হিসেবে গণ্য হবেন, সে সম্পর্কে তাদের ধারণা একেবারেই সীমিত। ‘শহীদ’, ‘জিহাদ’ এ ধরনের শব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যা তাদের কাছে অনুপস্থিত। ফলে তাদের শহীদ হওয়ার প্রলোভন দিয়ে সহজেই তথাকথিত জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা যায়। শহীদ হওয়াটা যেহেতু ইসলামের সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রতীক, তাই যে কোনো ব্যক্তি শহীদ হতে চাইতে পারেন। কিন্তু ইসলামী পরিভাষায় শহীদ কাকে বলা হয় তা নিয়ে অনেকের মাঝেই বিভ্রান্তি রয়েছে।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে যেনতেনভাবে মৃত্যুবরণ করলেই তাকে শহীদ বলে আখ্যায়িত করা যায় না। ইসলাম বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দিলে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনক্রমে যদি কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা হয় এবং সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মৃত্যুবরণ করেন তাহলে তাকে শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তবে তাকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইমানদার হতে হবে। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ছাড়া কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা হলে তাকে জিহাদ বলে মনে করার কোনো অবকাশ নেই। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রতিটি যুদ্ধেই রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ছিল। এছাড়া তিনি একবারের জন্য কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে আগে থেকে আক্রমণ করেননি। বরং শত্র“ দ্বারা আক্রান্ত হলেই কেবল আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করেছেন। শুধু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মৃত্যুবরণ করলেই তিনি শহীদ হবেন, তা নয়। পানিতে ডুবে, কঠিন কোনো রোগে বা ভয়াবহ দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে তিনিও শহীদ হিসেবে গণ্য হতে পারেন। শহীদ হতে হলে তাকে পরিপূর্ণ ইমানদার এবং ইসলামে দাখিল হতে হবে, যিনি ধর্মীয় আচার-আচরণের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমা পাওয়ার মতো যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেন। অর্থাৎ যিনি আল্লাহর ক্ষমা লাভ করে বেহেস্তে দাখিল হওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন এমন ব্যক্তিই শহীদ হওয়ার আশা করতে পারেন। কথায় বলে,
প্রেম ও যুদ্ধ কোনো নিয়মনীতির ধার ধারে না। কিন্তু ইসলাম এ প্রচলিত ধারণায় বিশ্বাসী নয়। ইসলাম যুদ্ধক্ষেত্রেও মানবিক নিয়মগুলো মেনে চলতে বলে। যেমন, ইসলামে বলা হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রেও কোনো মহিলা ও শিশুকে হত্যা করা যাবে না। এমনকি যুদ্ধকালীন অকারণে কোনো ক্ষেতের ফসল বা গাছের ফল নষ্ট করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইসলাম কখনোই সন্ত্রাসবাদ বা যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বা সম্প্রসারিত হয়নি। ইসলাম সবসময়ই উদার মানবিকতার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের কথা বলে। ইসলামের উদারতা দেখে অন্য ধর্মের মানুষ দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) যখন তায়েফে ইসলাম প্রচারের জন্য গমন করেন, তখন তায়েফবাসী নবীজীর প্রতি বিরূপ আচরণ করে। এমনকি তাঁর প্রতি ঢিল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে এক পর্যায়ে নবীজীর (সা.) দন্ত মোবারক শহীদ হয়। এ সময় হযরত জিরাইল (আ.) এসে নবীজীকে বলেন, আপনি অনুমতি দিলে আমি দুই পাহাড় দিয়ে তায়েফবাসীকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারি। তখন নবীজী বলেছিলেন, আমি ধ্বংসের জন্য আসিনি। আমি সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত হিসেবে এসেছি। এটাই হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম কারও প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার নীতি অনুসরণ করে না। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর প্রতি উদারতা প্রদর্শনের কথাও বলা হয়েছে।
যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে আত্মঘাতী হামলা চালায়, তারা কোনো দিনই বেহেস্তে যেতে পারবে না। কারণ ইসলামে আত্মহত্যা মহাপাপ। তিরমিজি শরিফের একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হত্যাকারীর ফরজ-নফল কোনো ইবাদতই কবুল হবে না।’ অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মানুষ হত্যার বিচার হবে।’ মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে সাতটি জিনিস মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে, তার প্রথম দুটি হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা এবং কাউকে হত্যা করা।’ ইসলাম শান্তির ধর্ম। বিশ্বমানবতার শান্তিই ইসলামের একমাত্র কাম্য। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক- ইসলাম শুধু মুসলমানদের শান্তির জন্য আসেনি। ইসলামের লক্ষ্য হল বিশ্বের সব মানুষ ও সৃষ্টিকূলের জন্য শান্তির ব্যবস্থা করা। মহান আল্লাহ যেসব নিয়ামত দান করেছেন তা সব মানুষের জন্যই, কোনো বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। যেমন সূর্যের কিরণ, চাঁদের আলো, বাতাস, খাবার এগুলো মানুষের জন্য নিয়ামত হিসেবে দেয়া হয়েছে। যেখানে সামান্য একটি পিপঁড়াকেও অকারণে মারার কোনো অধিকার মানুষের নেই, সেখানে নিরীহ মানুষকে হত্যা করার অনুমতি ইসলাম কখনোই দেয় না। যারা মনে করছে, ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করলেই বেহেস্তে গমন করা যাবে তারা চরম ভুল করছে।
ইসলাম কখনোই সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দেয় না। ইসলাম চায় শান্তি। ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য মহানবীর (সা:) আদর্শ ও দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করতে হবে। মহানবী (সা.) একজন বিধর্মীকেও জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করেননি। ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সম্প্রসারিত হয়নি। ইসলাম অনুকরণীয় মাধুর্য, উদারতা, মহানুভবতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে। এসব দেখেই মানুষ ইসলামের ছায়াতলে সমবেত হয়েছে। কাউকে জোর করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার কোনো সুযোগ নেই। যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে, তারা কোনোভাবেই ইসলামের প্রকৃত বাহক হতে পারে না। তারা বরং সাধারণ মানুষের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইদানীং ইসলামিক স্টেট বা আইএসের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। আইএস সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন সমর্থিত জোট কর্তৃক ইরাক দখলের পর। মার্কিন সমর্থিত ইরাক সরকার সেদেশের সেনাবাহিনীর বড় অংশকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এরা মূলত সাবেক ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সমর্থক ছিল। মনে করা হচ্ছে, এ বিলুপ্ত ঘোষিত সেনাদের একাংশই আইএস নামে তৎপরতা চালাচ্ছে। আবার অনেকের ধারণা, বাইরের একটি মহল ইসলামকে বিতর্কিত করার জন্য আইএস গঠন করেছে। কয়েক মাস আগে একটি ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ইসরাইলি গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী আহত আইএস সদস্যকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন। বিষয়টি রহস্যজনক নয় কি?
আইএস গঠন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করা যেতে পারে, আইএস কখনোই ইসলামের প্রতিভূ বা দৃষ্টান্ত হতে পারে না। কারণ ইসলাম কখনোই নিরীহ মানুষ হত্যা করে নির্মমতার মাধ্যমে বিস্তার লাভকে সমর্থন করে না। আইএস যা করছে তা ইসলামের নামে করা হলেও ইসলাম সমর্থিত নয়। তারা যে নির্মমতার পরিচয় দিচ্ছে তা কখনোই ইসলাম সমর্থিত হতে পারে না। আজকে বিশ্বব্যাপী ইসলামের নামে যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে এবং এতে যারা অংশ নিচ্ছে তারা প্রকৃত ইসলামের মাধুর্য সম্পর্কে মোটেও জ্ঞাত নয়। ইসলাম সম্পর্কে এদের চর্চাও তেমন একটা নেই। হেরা পর্বতের গুহায় নবী করিমের (সা.) ওপর প্রথম যে বাণী নাজিল হয়েছিল তা হচ্ছে, ‘ইকরা বিস্মি রাব্বুকা’ অর্থাৎ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃজন করেছেন।’ ইসলামে পড়াশোনা তথা জ্ঞানার্জনের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই সন্ত্রাস দূর করা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী যুবসমাজ বর্তমানে চরম হতাশার মধ্যে রয়েছে। তাদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। একজন তরুণ উচ্চশিক্ষা লাভ করার পর যদি কর্মসংস্থানের সুযোগ না পায়, তাহলে তার পক্ষে হতাশ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বিভ্রান্ত তরুণদের খুব সহজেই উগ্রবাদী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যায়। প্রকৃত শিক্ষার আলোয় এ বিভ্রান্তি দূর হতে পারে।
এম এ খালেক : কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.