প্রাক-প্রাথমিক থেকেই সুশিক্ষা প্রয়োজন

‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’- এ আপ্তবাক্যের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এ কথার গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর পর্ব থাকে। অর্থাৎ কোনো কিছু আরম্ভেরও একটি সূচনাপর্ব থাকে। জাতির মেরুদণ্ড গঠনে শিক্ষাকে যদি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হয় তবে তারও আগে প্রয়োজন সেই শিক্ষা অর্জনের পাটাতন নির্মাণ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষার নানা স্তরভেদ রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সাফল্যের সঙ্গে এ স্তরগুলো অতিক্রম করার জন্য প্রাথমিক স্তরের আগেই প্রস্তুতি গ্রহণ প্রয়োজন। এ প্রস্তুতি গ্রহণে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ শিশুর সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব বিকাশের ভিত্তিস্থাপন এবং প্রাথমিক পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে ৫+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছরমেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করেছে। শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা হিসেবে অভিহিত করে শিশুর প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের ভূমিকা সম্পর্কে শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে- এ শিক্ষাক্রম শিক্ষা ও বিদ্যালয়ের প্রতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি করবে, সুকুমার বৃত্তির অনুশীলনে শিশুকে অভ্যস্ত করবে। এ শিক্ষাক্রমের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যদের প্রতি সহনশীলতা এবং পরবর্তী আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য শৃংখলাবোধ সম্পর্কে শিশুদের ধারণা প্রদান।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ পর্যায়ক্রমে দেশের সব বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছিল। নিছক পাঠদান নয়, শিশুমনকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম এমন নানা উপকরণ রয়েছে এক্ষেত্রে। হাতের কাজ, ছড়া, গল্প, গান ও চিত্রাংকনের মাধ্যমে শিশুর সুকুমার বৃত্তিকে জাগ্রত করার পদ্ধতি রয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। রবীন্দ্রনাথ আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষালাভের কথা বলেছিলেন। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। শৈশবই মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিকাশের উপযুক্ত সময়। দেশপ্রেম, শ্রদ্ধাবোধ, আত্মনির্ভরশীলতা, সততা, শিষ্টাচার, দায়িত্বশীলতা ও শৃংখলাবোধ সম্পর্কে এ সময়েই যদি শিশুদের উদ্বুদ্ধ করা যায় তবে তারা নিঃসন্দেহে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে দেশের সম্পদে পরিণত হবে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ভিত্তি শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনাদর্শ নির্মাণে সহায়তা করবে এবং দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির প্রতি তাকে দায়িত্বশীল করে তুলবে। কিন্তু শুধু বিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব নয়।
পরিবার ও সমাজের ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রথম শিক্ষক। শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশে পরিবারের সক্রিয় সমর্থন অপরিহার্য। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের সাফল্যের জন্য পরিবারের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে শিশু বিদ্যালয়ে মাত্র ২.৫ ঘণ্টা ব্যয় করে। অবশিষ্ট সময়টুকু সে পরিবারের সঙ্গে থাকে। তাই শিশুর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় পরিবারের বড় ভূমিকা রয়েছে। সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে বিদ্যালয়। সমাজ যদি কলুষিত হয় তবে এর নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যালয়ে তথা শিক্ষার্থীদের নিঃসন্দেহে পিছিয়ে দেয়। বিদ্যালয়ের বিকাশে সহায়তা করা সমাজের অবশ্য কর্তব্য। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। খেলনা, শিক্ষা-উপকরণ প্রদান, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়ে তারা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনে পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে পারে।
২. সম্প্রতি বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে কিছু তরুণের সম্পৃক্ততা সমাজকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এটি শুধু আইনশৃংখলাজনিত সমস্যা নয়, এ সমস্যার শেকড় আরও গভীরে। সমাজতত্ত্ববিদ ও মনোবিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিবারে ও বিদ্যালয়ে সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই তরুণরা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মঘাতী পথ বেছে নিয়েছে। অথচ এ সমস্যার উপযুক্ত সমাধান রয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায়। মানবজীবনের প্রতিটি ইতিবাচক গুণ আয়ত্ত করার এবং নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য বর্জন করার নির্দেশনা রয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে। শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজ যদি এক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতা করে তবে আগামী দিনে আমরা লাখ লাখ আলোকিত মানুষ পাব, যারা তাদের দেশপ্রেম ও নৈতিকতার বলে আমাদের একটি উন্নত রাষ্ট্র উপহার দিতে সক্ষম হবে। তাদের সক্রিয় ভূমিকাই জাতির মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করবে। এজন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে অবিলম্বে এবং সর্বাগ্রে।
রাজীব সরকার : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ; জনপ্রশাসন পদক ২০১৬ প্রাপ্ত

No comments

Powered by Blogger.