বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন ব্লেয়ার

সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে ইরাকে হামলার যৌক্তিকতা ও ফলাফল নিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। ইরাক যুদ্ধে হতাহত ব্রিটিশ সৈন্যদের পরিবার ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগের কথা জানিয়েছে। ব্লেয়ার যাতে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে না পারেন এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য থাকতে না পারেন, সে জন্য আইনি নিষেধাজ্ঞা জারির দাবিও উঠেছে। ‘চিলকট রিপোর্ট’ নামে ঐতিহাসিক এই তদন্ত প্রতিবেদন গত বুধবার প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে মিলে ইরাকে যে হামলা চালিয়েছে, তা কোনো যৌক্তিক বিবেচনার ভিত্তিতে ছিল না। দেশটিকে নিরস্ত্র করার শান্তিপূর্ণ উপায়গুলো পাশ কাটিয়ে ওই হামলা চালানো হয়।
ভবিষ্যতে কোনো দেশে হস্তক্ষেপ কিংবা হামলা চালানোর আগে এই প্রতিবেদনের শিক্ষাগুলো মাথায় রাখতে যুক্তরাজ্য সরকারকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। ইরাকে হামলায় যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা অনুসন্ধান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সরকারের ভূমিকা তদন্তে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা স্যার জন চিলকটকে প্রধান করে ২০০৯ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি দীর্ঘ সাত বছর পর তাদের ঐতিহাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করল। স্যার জন চিলকটের নাম অনুসারে এ প্রতিবেদনকে ‘চিলকট রিপোর্ট’ বলা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এই তদন্তের প্রক্রিয়া বিভিন্নভাবে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাই প্রতিবেদনটি প্রকাশে অস্বাভাবিক সময় লেগে গেল। স্যার জন চিলকট বলেন, বিচার কিংবা রায় দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের নয়। তাঁরা কেবল ইরাক যুদ্ধের যৌক্তিকতা ও প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে কাজ করেছেন। তবে যেখানে প্রত্যাশিত মানদণ্ড লঙ্ঘিত হয়েছে, সেখানে কাঙ্ক্ষিত সমালোচনা করেছেন তাঁরা।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন ইরাকের তৎকালীন স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে, তিনি (সাদ্দাম হোসেন) বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। কারণ তিনি গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত গড়ে তুলেছেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতেই ইরাকে হামলার উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও একই দোহাই দিয়ে ইরাকে হামলা চালাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুমোদন নেন। শুরু থেকেই এ হামলার বিরোধিতায় ফুঁসে উঠেছিল যুক্তরাজ্যের মানুষ। ইরাক যুদ্ধে ১৭৯ জন ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হন। সরকারের ব্যয় হয় প্রায় ১০ বিলিয়ন পাউন্ড। যুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ ইরাকি নিহত হয় এবং ১০ লাখের বেশি বাস্তুহারা হয়। প্রায় ২৬ লাখ শব্দের চিলকট রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত রয়েছে—এমন তথ্য ছিল ভিত্তিহীন। মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হামলার পুরো পরিকল্পনা করা হয়।
ব্রিটিশ সৈন্যদের ইরাকে হামলায় অংশ নেওয়ার আইনি ভিত্তি কোনোভাবেই সন্তোষজনক ছিল না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য চেয়েছিল হামলা না চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখতে। কিন্তু মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাকে হামলার প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নেন টনি ব্লেয়ার। তদন্তে উঠে আসা টনি ব্লেয়ার ও জর্জ বুশের বার্তা আদান-প্রদানে দেখা যায়, ব্লেয়ার যেন ইরাকে হামলার পণ করেছিলেন। এক তার বার্তায় ব্লেয়ার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের কাছে লেখেন, ‘যা-ই ঘটুক, আমি আপনার সঙ্গে থাকব।’ ব্লেয়ারের বিচারের দাবিতে, ‘স্টপ দ্য ওয়ার কোয়ালিশন’ লন্ডনে বড় ধরনের বিক্ষোভ করে। আন্দোলনের সাফল্য দাবি করে বক্তারা বলেন, এই প্রতিবেদনই শেষ নয়, এটা ব্লেয়ারের বিচারের শুরু মাত্র।

No comments

Powered by Blogger.