সমাজের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন

পবিত্র রমজান মাসের বিদায়ী শুক্রবার (১ জুলাই) দেশি-বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজানের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জের কাটতে না কাটতেই পবিত্র ঈদের দিনে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জামাত শুরু হওয়ার পূর্বমুহূর্তে এক হামলার ঘটনা ঘটল। ধারণা করা যায়, হয়তো ঈদগাহ ছিল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, পুলিশের আত্মত্যাগ ও কর্তব্যপরায়ণতার কারণে হয়তো বড় ধরনের ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া গেছে। পূর্ণ তদন্তের পরই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। এর মধ্যে হামলাকারীদের মধ্যে নিহত একজন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যা পুলিশের ভাষ্য থেকে জানা যায়। ওই হামলাকারী তরুণ আবিরও একজন হারিয়ে যাওয়া সন্তান, যাঁর বাবা ওই হামলার এক দিন আগে ভাটারা থানায় জিডি করেন বলে প্রকাশ (প্রথম আলো, জুলাই ৯, ২০১৬ ইন্টারনেট সংস্করণ)।
এই দুই হামলার মধ্যে তেমন মিল নেই, তবে গুলশানের হামলা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসী সন্ত্রাসী হামলা। পারিপার্শ্বিকতা, ধরন ও উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং যাদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে, এর সব কটিতেই ছিল ইসলামিক স্টেট বা আইএসের তাত্ত্বিক ছাপ। অবশ্য পরে হামলাকারীদের ও রেস্তোরাঁর মধ্যে হত্যাযজ্ঞের যে ছবি এবং নিহতের সংখ্যা দেশের মানুষ জানার আগেই বিশ্বে আইএসের মুখপত্র ‘আমাক’-এর মাধ্যমে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাইট’ নামক সংস্থা দিয়ে ছড়িয়েছে, তাতে ওই হামলার সঙ্গে যে আইএসের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ধরে নিয়েছে। আমরা যতই বিষয়টিকে হোমগ্রোন বলি না কেন, এই হোমগ্রোনদের সঙ্গে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এসব দাবি হালকাভাবে নেওয়া যায় না।
এ হামলাকারীদের, বিশেষ করে গুলশানের হামলাকারীদের বয়স এবং পরিচয় পেয়ে দেশবাসী হতভম্ব হয়েছে, হওয়ারই কথা। এই দুই জায়গার হামলাকারীদের বয়স ১৮-২৬ বছরের মধ্যে এবং এঁদের বেশির ভাগ সেকু্যলার স্কুল-কলেজ বলে পরিচিত প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, উচ্চশিক্ষিত আধুনিক, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক। এঁদের পারিবারিক পরিচয় উদ্ঘাটিত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে এই তরুণেরা কেন ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এ ধরনের এমন আত্মঘাতী পথ বেছে নিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর তেমন সহজ নয়। বিশ্বব্যাপী প্রচুর গবেষণা চলমান, জানার চেষ্টা হচ্ছে কেন এসব তরুণ এ ধরনের পথ বেছে নিয়েছেন, যা উদ্দেশ্যবিহীন সহিংস অমানবিক পথ। ইরাক যুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে তথাকথিত আরব বসন্তের জের হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যে ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার মধ্য দিয়ে বিগত শতাব্দীর আশির দশকে আফগান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সংগঠিত মৃতপ্রায় আল-কায়েদার নবজন্ম ঘটে। এবং তারই জন্ম দেওয়া আইএসের উত্থান ঘটে বিস্ময়করভাবে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তাদের তৎপরতা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তা থেকে আমাদের এ ভূখণ্ডও বাদ যায়নি। বিগত দুই বছরে বাংলাদেশেও পুনঃজাগরণ হয়েছে ধর্মীয় আধারে পরিচালিত সন্ত্রাসী বলে পরিচিত বেশ কিছু সংগঠনের। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান জটিল পরিস্থিতির জের যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলিম দেশ বাংলাদেশে পড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বর্তমানে দুটি প্রধান গোষ্ঠীর দাবিকৃত কার্যকলাপই লক্ষণীয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম এবং অপরটি জেএমবি। এই সংগঠন দুটি যথাক্রমে আল-কায়েদা (যার উপমহাদেশীয় শাখার নাম আল-কায়েদা ইন হিন্দ) ও আইএসের তাত্ত্বিক ও কৌশলের অনুসারী।
এবং এমন ধারণার বহু কারণ রয়েছে। আমাদের দেশে গত দুই বছরে ঘটে যাওয়া টার্গেট কিলিং এবং হালের ঘটনাগুলোর ধরন দেখলেই এ বিষয়ে অনেকটা পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠে। এসব কর্মকাণ্ডের শ্রেণিবিন্যাস ও বিশ্লেষণ করলে এই দুই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের কৌশল ও তাত্ত্বিক ধারণার রেশ সহজেই চোখে পড়ে। এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর যে বৈশিষ্ট্যগুলো বৃহত্তর দুই সন্ত্রাসী সংগঠনের তত্ত্ব ও কৌশলের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে তা হলো, প্রথমত, টার্গেট নির্ধারণ, দ্বিতীয়ত, আক্রমণের ধরন, তৃতীয়ত, আক্রমণকারীদের বয়স এবং পরিচয়, চতুর্থত, আলোচিত দুই সংগঠনের তাত্ত্বিক ভিত্তিতে টার্গেট নির্ধারণ এবং টার্গেট ব্যক্তির বিভিন্ন মতবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। লক্ষণীয় যে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তার তিন-চতুর্থাংশের দায় নিয়েছে আইএস, যার মধ্যে গুলশানের হামলা অন্তর্ভুক্ত, এবং এক-তৃতীয়াংশের দায়দায়িত্ব নিয়েছে ‘আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ (একিউআইএস) এবং স্থানীয় সংগঠন যথাক্রমে জেএমবি এবং আনসার আল ইসলাম (পূর্বতন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম)। এসব দাবিদাওয়া যদিও আমাদের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দৃশ্যত নাকচ করেছে প্রতিটি ঘটনার পরপর। তাদের ভাষ্যমতে, এগুলোই ছিল স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কাজ। সে ধারণা গুলশানে হামলার পর হয়তো অনেকটা বদলাতে শুরু করেছে বলে মনে হয়, কারণ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে সহযোগিতার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলে স্থানীয় জঙ্গিদের ওপর নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহে আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীই যথেষ্ট হওয়ার কথা।
লক্ষণীয় যে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়াতে আল-কায়েদা, আইএসের যে প্রতিযোগিতা রয়েছে, তা গবেষকেরা নিশ্চিত করেছেন (প্রথম আলো, মে ৯, ২০১৬-এর প্রবন্ধ। ‘আল-কায়েদা-আইএস—কতখানি ঝুঁকিতে আমরা)। ওপরে বর্ণিত দায় স্বীকারের পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলেও আমাদের এই অঞ্চলে এ ধরনের প্রতিযোগিতার চিত্র ফুটে উঠবে। যদিও এই দুই সংগঠনের তত্ত্বের মধ্যে তেমন তফাত নেই, তবে কৌশলে যে তফাত রয়েছে বিশেষ করে টার্গেট নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, সেটাও গবেষণায় উঠে এসেছে। আল-কায়েদা ২০০৬ সাল থেকে তাদের কৌশল পরিবর্তন শুরু করলেও তা বেগবান হয় ২০১১ সাল থেকে, ওসামা–উত্তর সময় থেকে। অপরদিকে আইএস তার আগ্রাসী কৌশল নিয়েই ‘খেলাফত ঘোষণা’ দেয় জুন ২৯, ২০১৪ সালে। এক বছরের মধ্যেই ‘আগ্রাসী কৌশলে আইএস, আল-কায়েদাকে ছড়িয়ে যায় তাদের কৌশলে। দুটি সংগঠনই ব্যাপকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তবে আইএস এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে এবং সে কারণে তাদের সদস্যদের সিংহভাগ আধুনিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এদের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞান এবং ব্যবহার করা অত্যন্ত সহজতর হয়, যা হয়তো গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা এবং অনেক সুবিধাবঞ্চিত মাদ্রাসার ছাত্রদের পক্ষে সম্ভব হয় না। যারা গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা ও জঘন্য হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা তথাকথিত জিহাদি যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘থ্রিমা অ্যাপ’-মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করেছিল বলে তথ্যে প্রকাশ। এই পদ্ধতিতে মেসেজ অ্যাপ্লিকেশন সার্ভার থেকে মুছে ফেলা যায়।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আইএস আল-কায়েদা থেকে বহুদূর এগিয়ে। কিংস কলেজ লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব র্যাডিক্যালিজম (আইসিএসআর)–এর তথ্য অনুযায়ী ৯০টি দেশের প্রায় ২০ হাজার সদস্য বর্তমানে ‘আইএস জিহাদি’ হিসেবে রয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটেন থেকে ছয়-সাত শ বিভিন্ন স্কুলের ব্রিটিশ নাগরিক রয়েছেন। গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলার সঙ্গে জড়িত নিহত পাঁচ হামলাকারী জঙ্গির পরিচয় পাওয়ার পর বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, এমন হারিয়ে যাওয়া তরুণদের সংখ্যা কত? তার তেমন পরিসংখ্যান নেই। এঁদের অনেকের পরিবার থেকে পুলিশে জিডি করলেও এঁদের খুঁজে পাওয়া যায়নি বা সঠিক তদন্ত করার বিষয়টি হয়তো তেমন গুরুত্বসহকারে দেখা হয়নি। ছোট ছোট শহর ও প্রান্তিক অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাওয়া অথবা কথিত গুম হয়ে যাওয়ার বিষয় পুলিশের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে বহু পত্রপত্রিকায় অভিযোগ ছিল। আবার অনেক পরিবার হয়তো সামাজিক এবং অন্যভাবে হয়রানির আশঙ্কায় পুলিশে অভিযোগ করা থেকে বিরত রয়েছিল। হালে প্রায় ১০ জনের মতো হারিয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজে ছবি দিয়ে গণমাধ্যমের সহায়তায় আবেদন জানানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও এ ধরনের তথ্য প্রদানের জন্য অনুরোধ করেছেন। কাজেই পুলিশের কর্তব্য হবে এঁদের খুঁজে বের করা এবং পরিবারকে, তারা সমাজের যে স্তরেরই হোক না কেন, তাদের সহায়তা নিতে আশ্বস্ত করা এবং অত্যন্ত ধৈর্য ও সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টি খতিয়ে দেখা। এসব হারিয়ে যাওয়া তরুণ যদি ইতিমধ্যেই ‘জঙ্গি’ সদস্য হয়ে থাকেন, তাহলে অনুমান করা যায় তাঁরা প্রত্যেকেই দারুণ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছেন। ফিরে আসার ইচ্ছা থাকলেও হয়তো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। বিষয়টি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি। ইদানীং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়েছে এমন এবং পরবর্তী সময়ে খোঁজ না পাওয়ার খবরাখবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আবার প্রকাশিত হয়নি এমন অনেক ঘটনাও রয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
যাঁরা পরিবার থেকে বা অন্য কোথাও থেকে হারিয়ে গিয়ে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য হয়েছেন বা হওয়ার পথে রয়েছেন, তাঁদের ফিরে আসতে যে আহ্বান প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তা কীভাবে কার্যকর করা যায়, সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত। যাঁরা এখনো অভিযুক্ত হননি, তাঁদের কীভাবে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে ডিরেডিক্যালাইজশনের মাধ্যমে সমাজে রিহ্যাবিলিটেশন করা যায়, তা সরকারের ভেবে দেখা উচিত। এতে শতভাগ কাজ না হলেও এসব তরুণের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা যেতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ নতুন বিষয় নয়, অতীতেও এ ধরনের পদক্ষেপের নজির রয়েছে। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে তা হচ্ছে, কেন উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যম থেকে উচ্চশিক্ষিত যুবকেরা এ পথের পথিক হচ্ছেন? এ বিষয়ে আমাদের দেশে তেমন গবেষণা হয়েছে বলে মনে হয় না। এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা হওয়া উচিত, কারণ আমরা একটা সংকটে পতিত হয়েছি, এ অবস্থা থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, তার জন্য সামাজিক অঙ্গনের প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীদের। আমরা যে সংকটে পতিত হয়েছি সে সংকট শুধু আমাদের দেশেই হয়েছে, তেমন নয়। সারা বিশ্বই এখন এই সংকটের মোকাবিলা করার পথ খুঁজছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু সরকারি বা শুধু রাজনৈতিক উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, সমাজের প্রত্যেককেই যার যার অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। অন্যথায় যে ধরনের ক্ষতি হবে সেখান থেকে উত্তরণ ঘটানো দারুণ কঠিন হবে। এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.