সিআইএ’র থাবায় বিক্ষত আফ্রিকা

আফ্রিকার মাটিতে অনেকবারই রক্ত ঝরিয়েছে আমেরিকা। চালিয়েছে অবাধ গোয়েন্দা তৎপরতা ও গুপ্ত হত্যা। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ের কথা। সবে ঔপনিবেশিকতার অধীনতা থেকে বেরোতে শুরু করেছে আফ্রিকার দেশগুলো- কেউ স্বাধীনতা পেয়েছে আর কোনো কোনো রাষ্ট্র তখনও হাঁটছিল সে পথে। এমন সময় সেখানে জাতীয়বাদী ও বামপন্থীদের উত্থান ঠেকাতে পুরোদমে কাজ শুরু করল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)।
সদ্য মুক্তির স্বাদ পাওয়া আফ্রিকান রাষ্ট্রনেতারা তখন নতুন করে আবারও মার্কিন ঔপনিবেশিকতার গ্যাঁড়াকলে পড়তে রাজি ছিল না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হল- বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার নির্মম থাবায় একের পর এক ধসে গেলেন আফ্রিকার স্বাধীনচেতা নেতারা। মানবাধিকারের প্রবাদপুরুষ নেলসন ম্যান্ডেলাকে ঘায়েল করার মাধ্যমে শুরু হয় মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএ’র গোপন অভিযানের খেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলনরত অবস্থায় প্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯৬২ সালে ছদ্মবেশে থাকা অবস্থায় আটক হন তিনি। এরপর রাষ্ট্রদোহের অভিযোগে কারাদণ্ড। স্থিমিত হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতার প্রচেষ্টা। রোববার বিবিসির প্রতিবেদনে ম্যান্ডেলার প্রেফতারের পেছনে সরাসরি সিআইএ’র ভূমিকাকে দায়ী করা হয়। শতভাগ তথ্যপ্রমাণ আবিষ্কার করা সম্ভব না হলেও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা এবং সাবেক সিআইএ কর্মকর্তাদের বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয় আফ্রিকাজুড়ে সংস্থাটির গোপন তৎপরতা।
কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা
১৯৬০ সালে স্বাধীন হয় কঙ্গো এবং দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন প্যাট্রিক লুমুম্বা। প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম কয়েক মাসেই আফ্রিকাকে একত্রীকরণের উদ্যোগ নেন তিনি। ফলে ক্ষমতা এবং জীবন- দুটোই হারান তিনি। ১৯৬১ সালে হত্যা করা হয় তাকে। ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো বেলজিয়াম এর দায় স্বীকার করে। কিন্তু এই হত্যার সঙ্গে সিআইএ’র জড়িত থাকার সন্দেহ থাকলেও তা স্বীকার করেনি কেউ। তবে বিবিসি বলছে, কিউবার মতোই কঙ্গোতে কমিউনিজমের উত্থান নিয়ে চিন্তিত ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার। সরাসরি তার নিদের্শেই লুমুম্বাকে হত্যা করা হয়। অবশ্য এর আগেও লুমুম্বার টুথপেস্টে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে সিআইএ। কঙ্গোতে দায়িত্বে থাকা সিআইএ’র সাবেক কর্মকর্তা লরেন্স ডেভলিন ২০০০ সালে একথা স্বীকার করেন। তবে মার্কিন সরকারের প্রকাশিত গোপন নথি অনুসারে জানা যায়, একান্ত প্রয়োজন না হলে লুমুম্বাকে হত্যা নয় বরং তাকে অপসারণেই আগহী ছিল মার্কিন প্রশাসন।
ঘানার প্রেসিডেন্ট কোয়াম নক্রুমার অপসারণ
ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং জোট নিরপেক্ষ (ন্যাম) আন্দোলনের নেতা কোয়াম নক্রুমাকে পদচ্যুত করা হয় ১৯৬৬ সালে। এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতা হারালেও সিআইএ’র ইচ্ছাতেই তা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এক লেখায় সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা জন স্টকওয়েল এই তত্ত্বের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। মার্কিন সরকারের প্রকাশিত গোপন নথির তথ্যানুযায়ী নক্রুমার পতনকে অভিনন্দন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও নক্রুমার কারণে আফ্রিকায় আমেরিকার স্বার্থহানি হচ্ছিল বলেও দাবি করা হয়েছে।
এঙ্গোলার গৃহযুদ্ধে আগাস্টিনো নিটোকে ঠেকানোর চেষ্টা
১৯৭৫ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় এঙ্গোলা। এরপরেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায় দেশটি। এমপিএলএ নেতা আগাস্টিনো নিটো রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেন। সিআইএ তখন অন্য দুই প্রতিপক্ষ গ্রুপকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তা করে। বিদ্রোহীদের কাছে ৩০ হাজার রাইফেল পৌঁছে দেয় এই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। শুধু তাই নয় সংস্থাটির সাবেক গোয়েন্দা স্টকওয়েল জানান, শুধু অস্ত্র নয় বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থাও করেছিল সিআইএ। এমপিএলএ’র সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত সম্পর্ক ভালো থাকার কারণেই এ উদ্যোগ নিয়েছিল আমেরিকা।
চাদের বিদ্রোহী হিসেন হাবরিকে মদদ দান
১৯৮০ সালে চাদের ক্ষমতা দখলের জন্য হিসেন হাবরিকে অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল আমেরিকা। তবে লিবিয়ান নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি তখন চাদের রাষ্ট্রপতি গোকৌনি ওয়েদ্দিকে সহায়তা করায় বিফলে যায় সিআইএ’র প্রচেষ্টা। গাদ্দাফির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার কারণেই ওয়েদ্দিকে অপসারণের পরিকল্পনা করেছিল আমেরিকা। পরে ১৯৮২ সালে হাবরিকে দিয়েই চাদের ক্ষমতা দখল করায় সিআইএ।

No comments

Powered by Blogger.