মুজিব নন হাসিনা by কুলদীপ নায়ার
বাংলাদেশের
রাজধানী ঢাকা থেকে যেন আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে
প্রথমবারের মতো আমি ঢাকা সফর করি। বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার চার মাসের মধ্যে।
ঢাকা তখন ছিল ছোট্ট একটি শহর, নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে
প্রাণান্ত চেষ্টা করছিল। এ শহরের পুরনো গভীর সবুজ গিলে ফেলেছে বহুতল ভবন, এ
নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, এ গল্প কম-বেশি দুনিয়ার প্রত্যেক রাজধানীর
ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যতিক্রম সম্ভবত ইসলামাবাদ। এ শহরটি এখনও নিজের
উন্মুক্ততা ও গাছগাছালি ধরে রেখেছে।
১৯৭২ সালে ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ছিল দীর্ঘ সারি। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল লাগেজ। কিন্তু আমি শুনতে পাই যাত্রীরা ‘জয়বাংলা’ বলে স্লোগান দিচ্ছে, যেন তারা ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’তে (প্রমিজড ল্যান্ড) ফিরে এসেছে। আমি যখন শহর ঘুরতে বের হয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকগুলো মূল্যায়ন করলাম, আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম, এ দেশ আসলে পারবে তো! ৪০ বছর পর বিলাসবহুল এক বিমানবন্দর ও যাত্রীদের সুশৃঙ্খল সারি আপনাকে উত্তর দিয়ে দেবে, বাংলাদেশ পেরেছে!
আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, এ দেশ অনেক সংশয়বাদীকে ভুল প্রমাণ করেছে। দেশ ও দেশের বাইরে কর্মরত মানুষের কঠোর পরিশ্রম একদমই বৃথা যায়নি। বর্তমানে দেশটির প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশ। অথচ, যে দেশটি থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়েছে, সেই পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ২.৩ শতাংশ। আরও স্থিতিশীল ও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশিরা উন্মুখ হয়ে আছে বলে মনে হয়েছে আমার।
এটাই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের তীব্র পার্থক্য। কয়েকদিন আগেই আমি পাকিস্তান সফর করেছি। এ দেশটির চেহারা রীতিমত হতোদ্যম, ভবিষ্যতে কী হবে কেউ জানেই না। দেশটিতে সন্ত্রাসবাদের ভয়ও মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। অপরদিকে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করেছেন মৌলবাদীদের প্রতি কোনো মার্জনা না দেখিয়ে। আর উলফার মতো সংগঠনকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে, যারা একসময় বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে কার্যক্রম চালাতো।
একটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নোবেল লরিয়েট মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি আমি। তিনি তিক্ত কিংবা হতোদ্যম- কোনোটিই ছিলেন না। দরিদ্র মানুষকে আরও কীভাবে সহায়তা করা যায়, এ নিয়ে তার পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, সারাবিশ্ব থেকে ১০৮টি গ্রামীণ ব্যাংক তার কাছে সংহতির বার্তা পাঠিয়েছিল। আমি ভেবে অবাক হই, হাসিনা যদি তাকে দেশের ‘অ্যাম্বাসেডর-অ্যাট-লার্জ’ হিসেবে নিয়োগ করতেন, তাহলে বাংলাদেশ কতই না উপকৃত হতো! বাংলাদেশের জন্য সব দ্বার উন্মুক্ত হতো। তাকে অপসারণ করে বদনাম কুড়িয়েছেন হাসিনা। এটা আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও, হাসিনা অনুতপ্ত নন।
হাসিনার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো যে, তার মধ্যে কর্তৃত্বপরায়ণতার ছাপ আছে। তিনি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সহ্য করেন না। আমি দেখেছি, ইন্দিরা গান্ধী কিভাবে একই বিষয়গুলো ধারণ করেছিলেন। আর তার পিতা জহরলাল নেহরুর স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছিলেন। রাষ্ট্রকাঠামোতে ভারসাম্য বজায় রাখতে যেন ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যায় সে লক্ষ্যে নেহরু সেগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রব্যবস্থার যে ক্ষতি করে গিয়েছিলেন, তা থেকে এখনও ভারত সেরে উঠতে পারেনি।
প্রখ্যাত আইনজীবী কামাল হোসেন আমাকে বলেছেন, ইউনূসের মামলা লড়ার সময় তিনি এমনকি ঠিকঠাক একটি শুনানিও পাননি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শাসকরা বিচার বিভাগের ওপর চাপ দিয়ে থাকেন বলে শোনা যায়। বাংলাদেশও হয়তো এর কোনো ব্যতিক্রম নয়।
শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক আচরণ আরও ক্ষতি ঘটাতে পারে, কারণ সন্ত্রাসবাদী ও চরমপন্থি শক্তিগুলো ওত পেতে আছে। তারা ইতিমধ্যেই পরিস্থিতি যাচাই করেছে এবং তাদেরই কয়েকটি হরতালের মাধ্যমে তারা পরিস্থিতি অনুকূল বলেও বুঝতে পেরেছে। হাসিনা সচেতন যে, তার জনপ্রিয়তার গ্রাফ নিম্নমুখী।
তিনি বিরোধীদের চিন্তা করতে দিতে চান না যে, রাজপথ দখল ও হরতাল ডাকার সময় চলে এসেছে। হরতাল এ দেশের বিরোধী দলগুলোর একটি বাতিক, অপরদিকে দেশের জন্য সর্বনাশ।
বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধী দলকে বিলুপ্ত করেছিলেন, যখন তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। দেশে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদপত্র তিনি চেয়েছিলেন; ঠিক যেমনটি সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল প্রাভদা ও ইজভেস্তিয়া পত্রিকা। তিনি ছিলেন এমন এক আইকন যাকে জনগণ অত্যন্ত পছন্দ করতো। তাদেরকে তিনি যে কোনো কিছুই বোঝাতে পারতেন। তার কন্যা হাসিনার ওই মর্যাদা কিংবা তুমুল সমর্থন- কোনোটিই নেই। তিনি কেবল নিজের ক্ষতির পাশাপাশি পুরো জাতির ক্ষতিই করবেন।
(লেখক: কুলদীপ নায়ার ভারতের একজন প্রবীণ ও খ্যাতিমান সাংবাদিক। এ নিবন্ধটি নয়াদিল্লিভিত্তিক দ্য সানডে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ। ভাষান্তর: নাজমুল আহসান)
১৯৭২ সালে ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ছিল দীর্ঘ সারি। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল লাগেজ। কিন্তু আমি শুনতে পাই যাত্রীরা ‘জয়বাংলা’ বলে স্লোগান দিচ্ছে, যেন তারা ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’তে (প্রমিজড ল্যান্ড) ফিরে এসেছে। আমি যখন শহর ঘুরতে বের হয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকগুলো মূল্যায়ন করলাম, আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম, এ দেশ আসলে পারবে তো! ৪০ বছর পর বিলাসবহুল এক বিমানবন্দর ও যাত্রীদের সুশৃঙ্খল সারি আপনাকে উত্তর দিয়ে দেবে, বাংলাদেশ পেরেছে!
আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, এ দেশ অনেক সংশয়বাদীকে ভুল প্রমাণ করেছে। দেশ ও দেশের বাইরে কর্মরত মানুষের কঠোর পরিশ্রম একদমই বৃথা যায়নি। বর্তমানে দেশটির প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশ। অথচ, যে দেশটি থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়েছে, সেই পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ২.৩ শতাংশ। আরও স্থিতিশীল ও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশিরা উন্মুখ হয়ে আছে বলে মনে হয়েছে আমার।
এটাই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের তীব্র পার্থক্য। কয়েকদিন আগেই আমি পাকিস্তান সফর করেছি। এ দেশটির চেহারা রীতিমত হতোদ্যম, ভবিষ্যতে কী হবে কেউ জানেই না। দেশটিতে সন্ত্রাসবাদের ভয়ও মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। অপরদিকে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করেছেন মৌলবাদীদের প্রতি কোনো মার্জনা না দেখিয়ে। আর উলফার মতো সংগঠনকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে, যারা একসময় বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে কার্যক্রম চালাতো।
একটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নোবেল লরিয়েট মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি আমি। তিনি তিক্ত কিংবা হতোদ্যম- কোনোটিই ছিলেন না। দরিদ্র মানুষকে আরও কীভাবে সহায়তা করা যায়, এ নিয়ে তার পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, সারাবিশ্ব থেকে ১০৮টি গ্রামীণ ব্যাংক তার কাছে সংহতির বার্তা পাঠিয়েছিল। আমি ভেবে অবাক হই, হাসিনা যদি তাকে দেশের ‘অ্যাম্বাসেডর-অ্যাট-লার্জ’ হিসেবে নিয়োগ করতেন, তাহলে বাংলাদেশ কতই না উপকৃত হতো! বাংলাদেশের জন্য সব দ্বার উন্মুক্ত হতো। তাকে অপসারণ করে বদনাম কুড়িয়েছেন হাসিনা। এটা আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও, হাসিনা অনুতপ্ত নন।
হাসিনার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো যে, তার মধ্যে কর্তৃত্বপরায়ণতার ছাপ আছে। তিনি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সহ্য করেন না। আমি দেখেছি, ইন্দিরা গান্ধী কিভাবে একই বিষয়গুলো ধারণ করেছিলেন। আর তার পিতা জহরলাল নেহরুর স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছিলেন। রাষ্ট্রকাঠামোতে ভারসাম্য বজায় রাখতে যেন ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যায় সে লক্ষ্যে নেহরু সেগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রব্যবস্থার যে ক্ষতি করে গিয়েছিলেন, তা থেকে এখনও ভারত সেরে উঠতে পারেনি।
প্রখ্যাত আইনজীবী কামাল হোসেন আমাকে বলেছেন, ইউনূসের মামলা লড়ার সময় তিনি এমনকি ঠিকঠাক একটি শুনানিও পাননি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শাসকরা বিচার বিভাগের ওপর চাপ দিয়ে থাকেন বলে শোনা যায়। বাংলাদেশও হয়তো এর কোনো ব্যতিক্রম নয়।
শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক আচরণ আরও ক্ষতি ঘটাতে পারে, কারণ সন্ত্রাসবাদী ও চরমপন্থি শক্তিগুলো ওত পেতে আছে। তারা ইতিমধ্যেই পরিস্থিতি যাচাই করেছে এবং তাদেরই কয়েকটি হরতালের মাধ্যমে তারা পরিস্থিতি অনুকূল বলেও বুঝতে পেরেছে। হাসিনা সচেতন যে, তার জনপ্রিয়তার গ্রাফ নিম্নমুখী।
তিনি বিরোধীদের চিন্তা করতে দিতে চান না যে, রাজপথ দখল ও হরতাল ডাকার সময় চলে এসেছে। হরতাল এ দেশের বিরোধী দলগুলোর একটি বাতিক, অপরদিকে দেশের জন্য সর্বনাশ।
বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধী দলকে বিলুপ্ত করেছিলেন, যখন তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। দেশে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদপত্র তিনি চেয়েছিলেন; ঠিক যেমনটি সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল প্রাভদা ও ইজভেস্তিয়া পত্রিকা। তিনি ছিলেন এমন এক আইকন যাকে জনগণ অত্যন্ত পছন্দ করতো। তাদেরকে তিনি যে কোনো কিছুই বোঝাতে পারতেন। তার কন্যা হাসিনার ওই মর্যাদা কিংবা তুমুল সমর্থন- কোনোটিই নেই। তিনি কেবল নিজের ক্ষতির পাশাপাশি পুরো জাতির ক্ষতিই করবেন।
(লেখক: কুলদীপ নায়ার ভারতের একজন প্রবীণ ও খ্যাতিমান সাংবাদিক। এ নিবন্ধটি নয়াদিল্লিভিত্তিক দ্য সানডে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ। ভাষান্তর: নাজমুল আহসান)

No comments