শিশুহত্যার বিচার হয়তো হবে, শৈশব হত্যার? by আবুল মোমেন

সিলেটে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা
প্রথম আলোর খবরে দেখা যাচ্ছে, দেশে শিশুহত্যার হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে (৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। গত চার বছরে প্রায় ১ হাজার ১০০ শিশুকে খুন করা হয়েছে। কেবল গত বছরই দেশে ২১ হাজার ২২০টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গেছে। একমাত্র গত জানুয়ারিতেই হত্যা করা হয়েছে ২৯ শিশুকে। অর্থাৎ প্রায় দিনে একজন হত্যার শিকার হয়েছে। এর অনেক ব্যাখ্যা আইনবিদ, মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। মানুষের বেপরোয়া লোভ, সম্পদ অর্জনের মাত্রাহীন আকাঙ্ক্ষা, সাধারণভাবে উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠা ইত্যাদিকে দায়ী করা যায়। মানুষেরই তো আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষ থাকে, কিছুটা লোভও যে থাকে না তা–ও তো নয়। সমস্যা হলো মানুষ উত্তরোত্তর নিষ্ঠুর হচ্ছে, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়ছে এবং অনায়াসে জিঘাংসা বা হত্যার ইচ্ছা তাদের মনে জায়গা করে নিচ্ছে। এর অর্থ মানুষ বিবেচনাবোধ, সহিষ্ণুতা ও সংযম হারাচ্ছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকার অর্থ হলো সমাজের সহানুভূতি ও বিবেকবোধ ভোঁতা হয়ে আসছে। সোজা ভাষায়, আমরা মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি। কিছু কিছু ব্যতিক্রমী অসাধারণ মানবিক জীবনের দৃষ্টান্ত হাজির করে সম্ভবত সামগ্রিক সমাজ সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তকে খারিজ করা যাবে না।
তাহলে সমস্যা দাঁড়ায় দুটি—শিশুহত্যা এবং মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরিতে বা মনুষ্যত্বে ঘাটতি। এবার নজর দিতে হবে সমাজের দিকে এবং মানুষ তৈরির ক্ষেত্রগুলোর দিকে। না, এ সমাজ শিশুবান্ধব নয়। আজ বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সব শিশুই সুবিধাবঞ্চিত। শহরের ধনী থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত সব স্তরের শিশুকেই খাঁচাবন্দী জীবন কাটাতে হয়; সেটা বাসায় যেমন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তেমনই। বস্তির শিশুরা হয়তো তুলনামূলকভাবে মুক্তজীবন কাটায় কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পারিবারিক সাহচর্য-পরিচর্যা—এসবের অভাবে তার কাটে বঞ্চিত জীবন। একদল মুক্তিবঞ্চিত তো অন্য দল সুবিধাবঞ্চিত। শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য মুক্তি বা মুক্ত পরিবেশ আবশ্যিক প্রয়োজন। গ্রামে শহরের প্রভাব পড়ছে, তা ছাড়া মধ্যবিত্ত পর্যন্ত কেউ আর গ্রামে পরিবার নিয়ে বাসও করেন না। এখানে অবশিষ্ট লোকজনের জন্য মুক্তি কিছুটা থাকলেও তার সব চাহিদা পূরণ করে বড় হওয়ার সুযোগ-সুবিধার বঞ্চনা প্রকট। এর ওপর শিশুশিক্ষায় রাষ্ট্র নিজেই বৈষম্যকে এতই প্রশ্রয় দেয় যে শিশুর বিকাশে সমতা প্রতিষ্ঠা একেবারেই অসম্ভব।
আর সমাজ যে শিশুবান্ধব নয়, তার কী হবে? যেসব প্রাণীর জীবনে মূল কাজ কেবল খাদ্যান্বেষণ করে বেঁচে থাকা, তাদের জীবনযাপনের জন্য বসত ও বিচরণের বড় এলাকার প্রয়োজন হবে, এটা সহজ বুদ্ধিতে বোঝা যায়। শুনেছি শিকারি প্রাণী একটি বাঘের প্রয়োজন পড়ে পাঁচ বর্গমাইল বিচরণ এলাকা, দলবদ্ধভাবে থাকা তৃণভোজী হরিণের হয়তো কম লাগে। আবার অনেকে পরিযায়ীও হয়। পাখি তো হাজার মাইল পাড়ি দিয়েও নতুন সাময়িক বসতি খুঁজে নেয়। মানুষ খাদ্যশৃঙ্খলসহ আরও প্রাকৃতিক সীমা ভেঙে এক অর্থে স্বাধীন, আবার সেই মানুষ ক্রমে নিজেই নিজেকে ÿক্ষুদ্র বসতির ঘেরে বন্দী করে ফেলছে। উন্নত বিশ্বে আবাসস্থল ছোট হলেও উন্মুক্ত স্থানে পার্ক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে ব্যক্তির মুক্ত বিচরণের চৌহদ্দি অনেক বেড়ে যায়। শিশুদের জন্য আরও প্রশস্ত ব্যবস্থা তারা রেখেছে। একজন শিশুর স্বাভাবিক বিচরণের ব্যাপ্তি কতটা হওয়া দরকার এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি জানি না, কিন্তু এটুকু বুঝি যে তার অকারণ দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা, মাটি ও প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভের যে ক্ষুধা ও চাহিদা, তা মেটানো জরুরি। আমরা গরিব দেশের মানুষ, শিশুর কাছ থেকে মাঠ, আকাশ, মুক্ত বায়ু, সূর্যালোক-জ্যোৎস্নালোক, সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা, সমবয়সী বন্ধুজন-খেলাধুলা সব কেড়ে নিয়ে তাকে বড়জোর ধরিয়ে দিচ্ছি পাঠ্যবই, ঢুকিয়ে দিচ্ছি কোচিং ক্লাসে, বসিয়ে দিচ্ছি প্রাত্যহিক পরীক্ষায়। কেমন মন নিয়ে বড় হচ্ছে এই শিশু?
একদিকে বঞ্চনা আর জিপিএ-৫ পাওয়ার চাপ আর অন্যদিকে তার স্বাভাবিক চাহিদা পূরণের অভাব। চাপ আর ক্ষোভ তাকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেবে? জিপিএ-৫-এর সাফল্যের জন্য তার শৈশব জিম্মি করে ফেলছি না? এ ব্যবস্থায় শিশুদের সঙ্গে বড়দের সম্পর্ক চলে সাধারণত ধমক আর ঘুষের ওপর (পরীক্ষায় ভালো করলে বেড়াতে নেব, বাসায় চুপচাপ থাকলে চায়নিজ খাওয়াব ইত্যাদি)।
যারা শিশুহত্যা করে শেষ পর্যন্ত তাদের পরিচয় হয়তো জানা যায়, কারও কারও শাস্তিও হয়। কিন্তু যারা প্রতিনিয়ত শৈশব হত্যা করছে? দুটিই তো ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত অপরাধ। তবু আমরা এ দুইয়ের মধ্যে একটা পার্থক্য টানতে চাইব। শৈশব হত্যার ক্ষেত্রে হয়তো অসচেতনতা একটি বড় কারণ। আমরা তাড়াহুড়ো করে উন্নয়ন ঘটাতে চাইছি, যার অর্থ সড়ক-সেতু, ঘরবাড়ি ও স্থাপনা বানিয়ে যাওয়া। মুক্তস্থান, মাঠ, পার্ক ও প্রকৃতিকে দখল করে জলাঞ্জলি দিয়েই তা করা হচ্ছে। আমি এর জন্য এককভাবে সরকারকে দায়ী করব না। সমাজ এসব চাহিদা নিয়ে দাবি তো তুলছেই না, বরং ব্যক্তি নিজের জায়গাজুড়ে বাড়ি আর দোকানপাটই তো বানাচ্ছেন। খালি জায়গায় অর্থনৈতিক ক্ষতি, স্থাপনা তৈরি হলে লাভ মেলে। ফলে সমাজ ও সরকার যৌথভাবেই একযোগে এ কাজ করছে। সুবিধা হলো শৈশব হত্যা করলে হাতে রক্তের দাগ লাগে না, কাউকেই নির্দিষ্টভাবে অপরাধী বলা যায় না।
কিন্তু এবার একটা কথা বলতে চাই। শৈশব হত্যা থেকে শিশুহত্যা তো খুব দূরে নয়। আপনারা সিলেটের রাজন হত্যার ভিডিওর কথা চিন্তা করুন। তামাশা হিসেবে শিশুহত্যা ‘উপভোগ’ করছিলেন অনেকে। কেউ এগিয়ে এলেন না। যে একজন এগিয়ে এলেন, তাঁর উদ্দেশ্য মোবাইলে জ্বলজ্যান্ত হরর ফিল্ম ধারণ এবং সেটা সর্বসাধারণে ছড়িয়ে দিয়ে তৃপ্তি লাভ! আর কিছু পরিবারে নিষ্ঠুর পিতা বা মাতা কিংবা অন্য অভিভাবক বা সমাজ তো অহরহ খেলার আসর থেকে উঠিয়ে শিশুকন্যাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাচ্ছেন। ঘরে ঘরে কত ছেলে, কত মেয়ের সুরের, রঙের, কাব্যের, নৃত্যের, অভিনয়ের ক্ষুধা ও প্রতিভাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া হয় একমাত্র মোহ জিপিএ-৫-এর পেছনে ছুটিয়ে? শিক্ষা ও কলা, পরীক্ষা ও খেলা, জ্ঞানচর্চা ও সৃজনশীলতার যে সহাবস্থান করার কথা তা যে আমরা মনেই রাখি না। তাই শিশু এবং শৈশবের ওপর স্টিম রোলার চলছেই।
সাধারণভাবেই শিশুর বেশির ভাগ ইচ্ছার ওপর আমরা নিষেধের কপাট টেনে দিই। শিশু যদি বলে লাফ দিই, অভিভাবক বলেন কাজ নেই, হাত-পা ভাঙবে। শিশু যদি বলে প্রজাপতি ধরব, মা বলবেন, রোদে ঘুরলে অসুখ করবে। শিশু যদি বলে গাছে চড়ব, পেয়ারা পাড়ব, বাবা বলবেন কাজ নেই, পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে। শিশু যদি জ্যোৎস্নায় বাইরে যেতে চায়, মা বলবেন, কী সর্বনাশ! ঠান্ডা লাগবে। এমনই দৃষ্টান্ত অজস্র দেওয়া যায়। শিশুর প্রতি আমাদের এই মজ্জাগত না-কে হ্যাঁ-তে পরিণত করতে হবে। শিশু ব্যথা পাবে, হাত ভাঙতেও পারে, মাথা কাটতে পারে (মাথা ফেটে যায় না), চোট-ব্যথা একটু লাগতেই পারে। কিন্তু এসবই জীবনের অংশ। সাবধানতা ভালো, কিন্তু শিশুকে ফার্মের মুরগি বানিয়ে ফেললে সর্বনাশ। ফার্মের মুরগির মুরগিত্বে ঘাটতি থাকে। সে ওড়ে না, ডাকে না, এমনকি বিশেষ নড়াচড়াও করে না; কেবল খায়, মলত্যাগ করে, ডিম পাড়ে, ঘুমায়। যে শিশু খেলে না, দৌড়ঝাঁপ করে না, একটু গায় না, নাচে না, আঁকে না, তার মানসিক প্রতিবন্ধিতা তৈরি হয়, মানুষ হিসেবে ঘাটতি নিয়ে সে বড় হয়। তারাই সদলে এ সমাজকে উনমানুষের সমাজে পরিণত করবে। পরিণতিতে দেখা দেয় মনুষ্যত্বের সংকট। কবে কবি বলেছেন ‘মানুষের গভীর গভীর অসুখ এখন’।
সত্যিই শিশুরা আমাদের বিবেচনার মধ্যে বিশেষ থাকে না। বাড়ির শিশুটির জন্য স্কুল, কোচিং আর জিপিএ-৫-এর ব্যবস্থা হলেই অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন শেষ হলো। তার আরাম বা বিচরণক্ষেত্র ছোট হয়ে গেল, সেটা আমরা লক্ষই করি না। মনে রাখি না যেসব শিশু হারিয়ে যায় তাদের। কত শিশু প্রাণ হারিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে সে হিসাব কি আমরা রাখি? জীবন শুরুই হয়নি বলে তাদের তো কোনো জীবনী লেখা হয়নি। তাদের নামধামও কেউ মনে রাখেনি, এমনকি সংখ্যাও নয়। তাই অবলীলায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলি। এদের কি বাদ দেওয়া যাবে সে হিসাব থেকে?
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, শুধু পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তসংলগ্ন শরণার্থী শিবিরগুলোতে জুলাই পর্যন্ত ছয় লাখ শিশু প্রাণ হারিয়েছে। আর  ১২ সেপ্টেম্বর মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি শরণার্থী শিবির ঘুরে জানিয়েছিলেন, এ পর্যন্ত আট থেকে দশ লাখ শিশু এই যুদ্ধের বলি হয়েছে। তারা মূলত ডায়রিয়া ও ডায়রিয়া–জাতীয় রোগেই প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধই তো তাদের মৃত্যুর কারণ। ইউনিসেফ থেকে বলা হয়েছিল বর্ষা দীর্ঘায়িত হলে শিশুমৃত্যুর হার আরও বাড়বে। প্রবীণদের স্মরণ থাকবে, ১৯৭১ সালে বর্ষা দীর্ঘায়িত হয়েছিল। এডওয়ার্ড কেনেডি আরও বলেছিলেন, শরণার্থীদের ৪০ শতাংশ শিশু ও বৃদ্ধ, যাদের জীবন ছিল হুমকির মুখে।
শিশুহত্যা বন্ধ করতে হলে শৈশব হত্যা বন্ধ করতে হবে, শিশুহত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের দিকে তাকাতে হবে। সব উন্নয়ন পরিকল্পনায় শিশু এবং মানুষ এবং তাদের মুক্ত প্রাকৃতিক বিচরণক্ষেত্র এবং সেই সূত্রে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে সবার আগে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.