ক্রসফায়ারে বিচার বিভাগ? by ডক্টর তুহিন মালিক

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ
এক. বেশ ক’দিন ধরে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের মধ্যে চলা বাকযুদ্ধ যেন থামতেই চাচ্ছে না। দুই পক্ষের এই বাকযুদ্ধে ইতোমধ্যেই মারাত্মক হতাহত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি (ত্রয়োদশ সংশোধনী) বাতিলের রায়ের বৈধতার প্রশ্নটি। আরো হতাহত হয়েছে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায়সহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, দশম পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈধতা পর্যন্ত। এমনকি এতে করে পুরো বর্তমান সরকারের সাংবিধানিক অবৈধতাও আজ জনমনে স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। আর দু’পক্ষের এই ক্রসফায়ারে সরাসরি নিহত হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পর লেখা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিলের রায়টি। কিন্তু তাতেও যেন ক্ষান্ত হচ্ছে না। এর সাথে প্রায় প্রতিদিনই যেন বিচার বিভাগে নতুন নতুন সঙ্কটের জন্ম দিয়ে চলেছেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। অবসরে যাওয়ামাত্রই তিনি নিত্যদিন হরেক রকমের সভা, সেমিনার, টকশোয়ে গিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে শান্তি কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে রাজাকার বলে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে তিনি খালেদা জিয়ার প্রধান মুখপাত্র বলেও দাবি করছেন। অবসরের সাথে সাথেই বিচারপতি মানিক খালেদা জিয়ার বাসভবন ঘেরাও করেছেন। খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ও দেশ থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্নের রাজনৈতিক স্লোগানও দিয়েছেন। অথচ তখনো তার হাতে ৬৮টি মামলার রায় অলিখিত অবস্থায় জমা পড়ে আছে।
দুই. অন্য দিকে, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার মেয়াদের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে লিখিত বিবৃতিতে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন, ‘অবসরের পর বিচারপতিদের লেখা রায় বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী’। তিনি আরো বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন। কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না। আদালতের নথি সরকারি দলিল। একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের কাছে সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে দস্তখত করার অধিকার হারান।’ বিচারপতি মানিক এতে আরো যেন ক্ষেপে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের গাছতলায় প্রেস কনফারেন্স করে প্রধান বিচারপতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেন। জবাবে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি ছাড়া কোর্ট প্রাঙ্গণে সব ধরনের প্রেস কনফারেন্স নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মানিক সাহেব প্রধান বিচারপতির সব নির্দেশ অমান্য করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে উল্টো বরং প্রধান বিচারপতিকেই হুমকি দিয়ে সতর্ক করেন।
তিন. এর মধ্যে গত পরশু সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী বলেন, ‘বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের সর্বনাশ করছেন। বিচারপতি মানিক তার আচরণে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি হতাশাগ্রস্ত, উন্মাদ।’ বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে থাকা সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি যদি একজন বিচারককে উন্মাদ বলে সাব্যস্ত করেন, তাহলে সেই ‘উন্মাদ’ বিচারকের লেখা সংবিধান সংশোধনী বাতিলের রায় কতটা বৈধ বলে গণ্য হবে? অন্য দিকে, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বরাবরই প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে বলে আসছেন, ‘আমি মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলার রায় দিয়েছি। জামায়াত নেতা সাঈদীকে তো আমি ছাড়া আর কেউ ফাঁসি দেয়নি।’ বিচারপতি মানিক ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর অবসরে গিয়ে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় জমা দিয়ে মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বিচারপতি মানিক অবসরে গিয়ে এই তিন মাসের মধ্যেই মিডিয়া, টকশো, মিটিং, মিছিল করে প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন, তিনি রাজনৈতিক দলের নেতা এবং একমাত্র তিনিই মাওলানা সাঈদীকে ফাঁসি দিয়েছেন। এক দিকে তিনি রাজপথে মিছিল করে খালেদা জিয়ার বাড়ি ঘেরাও করছেন, অন্য দিকে তিনি মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায় লিখছেন। এখন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর সাব্যস্ত মতে, বিচারপতি মানিক যদি উন্মাদই হন, তাহলে অবসরে গিয়ে তার লেখা মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায়ও বা কী করে বৈধ বলে গণ্য হবে? আর এমনিতেও তো বর্তমান প্রধান বিচারপতির বক্তব্য মতে, অবসরের পর বিচারপতিদের লেখা রায় বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী।
চার. আসলে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রধান বিচারপতি হওয়ার রেসে হেরে যাওয়ার পরপরই তার সাথে প্রধান বিচারপতির মধ্যে সাংঘাতিক সঙ্ঘাতের জন্ম নেয়। বিচারপতি মানিককে ব্রিটিশ নাগরিক উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি তার রায় লেখা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তার বেতন, পেনশন ও সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ রাখার আদেশ দান করেন। এ নিয়ে চিঠি, পাল্টা চিঠি, মানহানির অভিযোগ, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘন ও বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের অযোগ্যতার অভিযোগ আনেন বিচারপতি মানিক। সবশেষে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান বিচারপতির অভিসংশন (অপসারণ) চেয়ে বিচারপতি মানিক চিঠি পর্যন্ত পাঠান, যা তখন সারা বিশ্বে বিরল একটি ঘটনারও জন্ম দেয়। তবে বেশ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান বিচারপতির অভিসংশন (অপসারণ) চেয়ে বিচারপতি মানিকের চিঠি বঙ্গভবনে পৌঁছার আগেই মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীর হাতে চলে এলে বিচার বিভাগের এই অন্দরকলহ মানুষের মুখে মুখে চলে আসে। শুধু তাই নয়, এর আগেও বিচারপতি মানিককে লেখা প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের সব চিঠি এবং তার পাল্টা চিঠিগুলোও গণমাধ্যমসহ সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুতগতিতে চলে আসে। বিচারপতি মানিকের চিঠিগুলোয়ে বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য সর্বসাধারণ অবগত হওয়ায় এই চলমান অন্দরকলহ একসময় রূপ নেয় প্রকাশ্য যুদ্ধে। এতে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, যেখানে বিচার বিভাগের গায়ে অবমাননার সামান্য অভিযোগে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড মাথা পেতে নিতে হয়, সেখানে প্রধান বিচারপতিসহ পুরো বিচার বিভাগকে হাসি-তামাশায় রূপান্তর করেও কোনো অবমাননার অভিযোগ আনা হচ্ছে না কেন? কারণ বিচারপতি মানিক বিচারপতি থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব দলীয় এজেন্ডা আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন, তা দলের ইতিহাসে কখনো কোনো প্রধান নেতাও এর আগে করে দেখাতে পারেননি। তাই বিচারপতি মানিকের খুঁটির জোর কোথায় তা আইন অঙ্গনের সবার জানা ছিল বলেই তিনি এখনো এতটা দুরন্ত, প্রতিরোধহীন। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনমন্ত্রী, বার কাউন্সিল কিংবা সুপ্রিম কোর্ট বারের নেতারা পর্যন্ত বুঝে গেলেন তাকে থামানো কঠিন। কিন্তু এতদিন পর এখন আস্তে আস্তে করে মুখ খুলছেন অনেকে। স্বয়ং আইনমন্ত্রী গত পরশু বিচারপতি মানিকের নাম শুনেই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক আলোচনা সভায় তার অংশগ্রহণের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলেন। অ্যাটর্নি জেনারেলও দেখছি এখন চেষ্টা করছেন কিছুটা মুখ খোলার। কিন্তু এই মুখ খুলতে খুলতে যে বেলা পার হয়ে গেছে! বিচার বিভাগকে রক্তাক্ত করে তর্কযুদ্ধের ক্রসফায়ারের গুলি এখন যে সরকারের গায়েই গিয়ে বিঁধেছে।
পাঁচ. বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নতুন কিছু নয়। গতবারের সংসদের ১৪তম অধিবেশনে তোফায়েল আহমেদসহ আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা বিচারপতি মানিককে সংসদে তুলোধনা করেছেন। তোফায়েল আহমেদ বিচারপতি মানিককে তখন ‘স্যাডিস্ট’ বলেও অভিহিত করেন। তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ পর্যন্ত তখন বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে রুলিং দিয়েছিলেন। স্পিকার তখন কটাক্ষ ভাষায় বলেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে’। তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। আবার তার কাছেই বর্তমান প্রধান বিচারপতির অভিসংশন (অপসারণ) চেয়ে আবেদন করে রেখেছেন রুলিং পাওয়া সেই বিচারপতি মানিক। তার বিরুদ্ধে মারাত্মক মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ পর্যন্ত জমা দেয়া আছে। কিন্তু তার খুঁটির জোর এতই শক্ত যে, এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে শত অভিযোগ দাখিল করলেও কোনো কাজ হয়নি। বরং বিচারপতি থাকাকালে তিনি তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার রুল পর্যন্ত জারি করেছিলেন। দেশের অসংখ্য গুণী মানুষকে তিনি তার এজলাসে অপমানজনকভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। রাস্তায় তার গাড়ি ট্রাফিক সিগনালের লাল বাতিতে আটকে দেয়ার অপরাধে ট্রাফিক পুলিশকে কান ধরে ওঠবস করিয়েছেন। পুলিশের আইজির পর্যন্ত চাকরি চলে যায় তাকে সম্মান না করার কারণে। অর্থাৎ, তার মানে, তিনি বিচারকের পদে থাকতেই তোফায়েল আহমেদের ভাষ্য মতে, ‘উন্মাদ’ ছিলেন। এখন তো সাবেক চিফ জাস্টিজও একই কথা বলছেন। তাই একজন ‘উন্মাদের’ দেয়া ফাঁসির আদেশ জনগণের চোখে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে তা সময়ই বলে দেবে। এরই মধ্যে গত বুধবার বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে দুদকে তথ্য গোপনের অভিযোগ দায়ের করেছেন এক আইনজীবী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দ্বৈত নাগরিক হলেও বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ার সময় কাগজপত্রে এর কোনো তথ্য দেননি, যা প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আরেক আইনজীবী গত মঙ্গলবার বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে বিচারপতি মানিকের জাজশিপ প্রত্যাহারের আবেদনও জানান।
ছয়. সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী স্পষ্টত বলে দিয়েছেন, ‘অবসরের পর রায়ের অর্ডার পোরশন পরিবর্তন করে লেখা রায় ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে’। এতে করে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পর লেখা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিলের রায়ের বৈধতাটি বড় ধরনের আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে। কারণ, অবসরের ১৬ মাস পর তার লেখা পূর্ণাঙ্গ রায় আগের দেয়া মূল রায়ের মৌলিক অংশগুলোকে পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছিল। এই মামলার রায়ে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করা হয়েছিল, সংসদ চাইলে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখতে পারবে। কিন্তু অবসরের ১৬ মাস পর বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়ে এই দুই মেয়াদের অংশটি বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা হয়। আর এ কারণেই মানুষের মনোযোগের জায়গাটুকুও এতদিন পর কেবল এটুকুতেই সীমাবদ্ধ। বিচারকদের অবসরের পর লিখিত রায়গুলো বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিলের রায়সহ সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায়গুলোও কি তাহলে বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী বলে অবৈধ বিবেচিত হবে? অবসরের পর লিখিত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় কি বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী বলে অবৈধ বিবেচিত হবে? বিচারপতিরা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন বিধায় তারা যদি এভাবে সংবিধান পরিপন্থী রায় লেখেন, তাহলে তারাও কি সংবিধান লঙ্ঘনের অপরাধে অভিযুক্ত বলে গণ্য হবেন? আর সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু সংবিধানের অভিভাবক; তাই প্রধান বিচারপতি তার ওপর অর্পিত সংবিধান সুরক্ষার দায়িত্ব পালনে কি এতদিন ব্যর্থ ছিলেন?
এসব বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী রায়ের জন্য এতবড় জাতীয় বিপর্যয়, সহিংসতা, হানাহানি ও সঙ্কটের সৃষ্টি হলো তার দায়দায়িত্বই বা কে নেবে? আর দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সম্মতিতেই তো এক বছর ধরে অসংখ্য মামলার রায় বিচারকেরা অবসরে গিয়ে লিখেছেন, সেগুলোর দায়দায়িত্বই বা তিনি নেবেন কি-না? এতে সবচেয়ে বড় সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ বিবেচিত হলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি তখন বৈধ বলে গণ্য হবে। পাশাপাশি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, দশম সংসদ, প্রধানমন্ত্রীসহ বর্তমান সরকার- সবই বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলে গণ্য হবে। অনিবার্যভাবেই সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে বড় ধরনের বিপর্যয় ও ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়বে রাষ্ট্রের প্রথমসারির গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তি। এতে সরকারের জন্যও বড় ধরনের বিপর্যয় অপেক্ষারত। দেশের মানুষ তো বটেই, বহির্বিশ্বে সরকারের বৈধতা নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়বে। নিরপেক্ষব্যবস্থায় সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হবে সরকারকে। ভবিষ্যৎ সরকারও বড় ধরনের রসদ পেয়ে গেল সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে বর্তমান শাসকদের বিচারের মুখোমুখি করার।
শীর্ষ নিউজ, ঢাকা : ‘অবসরের পর রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থি’ এ সংক্রান্ত প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এ বি এম নুরুল ইসলাম।
সুপ্রীম কোর্টের ল’ রিপোর্টার্স ফোরামে সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন তিনি।
আইনজীবী এ বি এম নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রধান বিচারপতি প্রথমদিন যে কথাটি বলেছেন তা ঠিকই বলেছেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। এ ব্যাপারে আমাদের শ্বাসনতন্ত্রের আর্টিক্যাল ৯৯ ও ১৪৮’ এ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো বিচারপতি আর বিচার সংক্রান্ত কোনো কাজ করতে পারবে না।’
‘আমাদের কাছে বহু প্রমাণ আছে, দুই থেকে তিন বছর আগে প্রকাশ্য কোর্টে রায় হয়েছে কিন্তু রায়গুলো এখনও পর্যন্ত লিখিত আকারে প্রকাশ হয়নি’, যোগ করেন তিনি।
বিচারকদের স্বদিচ্ছাই পারে সময়মতো রায় প্রকাশ করতে- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘নিম্ন আদালতে স্ট্রোনোগ্রাফার পান না জজেরা। তারা সারারাত ধরে হাতে লিখে রায় প্রকাশ করেন। এখানে (সুপ্রীম কোর্টে) তো তারা (বিচারকরা) স্ট্রোনোগ্রাফার পাচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘রায় দেরিতে প্রকাশে আমরা (আইনজীবীরা) মক্কেলদের কাছে বিভ্রান্ত হচ্ছি এবং দেশবাসী সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
‘আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রায় ২০ বার উদ্যোগ নিয়েছি। তবুও এর কোনো সুরাহা হয়নি’ বলেন তিনি।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও
সংবিধানবিশেষজ্ঞ
e-mail: drtuhinmalik@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.