হাফিজুর–আবু বকরদের জন্য দুফোঁটা অশ্রু by সোহরাব হাসান

হাফিজুর মোল্লা ও আবু বকর সিদ্দিক
হাফিজুর মোল্লা ও আবু বকর সিদ্দিক দুজনই গরিব মা-বাবার সন্তান। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মা-বাবার দুঃখ ঘোচাবেন—এ আশায়। কিন্তু তাঁরা পারলেন না। যেমন পারেননি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবায়ের। যেমন পারেননি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঈদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপস পাল। শাহজালালের সুমন চন্দ্র দাস।
ছয় বছরের ব্যবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ঘটনায় যে দুজন ছাত্র করুণ মৃত্যুর শিকার হলেন, তার নেপথ্যে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির কতিপয় নেতা-কর্মীর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। টাঙ্গাইলের দিনমজুর বাবার সন্তান আবু বকর সিদ্দিক পড়তেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। থাকতেন স্যার এফ রহমান হলে। ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ অনেকেই হত্যার বিচার করা হবে বলে ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু ছয় বছর পর এখন দেখা যাচ্ছে, হত্যা মামলার তদন্তই ঠিক হয়নি। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, পুলিশের তদন্তে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবু বকর মারা যান বলে জানানো হলেও সেই অস্ত্রটি কী, তা উল্লেখ করা হয়নি। ঘটনার কোনো আলামত রাখা হয়নি। ফলে মামলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে খোদ সরকারপক্ষের কৌঁসুলিরাই সন্দিহান। তাঁদের মতে, তদন্ত যথাযথ হয়নি। মামলাটি পুনরায় তদন্তের দাবি রাখে।
ঘটনার পর একই হলের আবাসিক ছাত্র ওমর ফারুক বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। তিনি নিজেও ওই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। আবু বকর হত্যা মামলাটির তদন্ত শেষে এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় শাহবাগ থানার পুলিশ। পরে বাদীর নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে সিআইডি মামলাটির অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আগের আটজনসহ আরও দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়। আসামিদের সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
মামলাটি বর্তমানে ঢাকার ৪ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। মামলার ২২ জন সাক্ষীর মধ্যে ইতিমধ্যে আটজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। যাঁদের মধ্যে সাতজনই প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী এবং তাঁরা ওই হলের তৎকালীন ছাত্র ও একজন আবাসিক শিক্ষক।
মামলার নথিতে থাকা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, শক্ত ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবু বকরের মাথা থেঁতলে যায়। কিন্তু পুলিশের দুটি অভিযোগপত্রের কোথাও বলা হয়নি, ভোঁতা অস্ত্রটা কী জিনিস। শুধু বলা হয়েছে, স্যার এ এফ রহমান হলের সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়। আসামিরা রড, লাঠি, হকিস্টিক দিয়ে মারামারি করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কোন কোন আসামির অস্ত্রের আঘাতে আবু বকর নিহত হন, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই।
আবু বকরের বড় ভাই আব্বাস আলী বলেছেন, ‘এটা তো নিশ্চিত, আমার ভাইকে কেউ না কেউ হত্যা করেছে। যারাই খুন করেছে, তাদের ফাঁসি চাই।’
কিন্তু বাংলাদেশে যে গরিব মানুষের সব চাওয়া পূরণ হয় না, সেটি হয়তো আব্বাস আলী জানেন না।
দ্বিতীয় ঘটনার শিকার ফরিদপুরের অটোরিকশাচালক ইসহাক মোল্লার ছেলে হাফিজুর মোল্লা। মাস খানেক আগে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে। কিন্তু এই শহরে তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না, যঁাদের বাসায় থাকতে পারেন। মেসে বা বাসাভাড়া নিয়ে থাকার সামর্থ্যও তাঁর নেই। তাই ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ ধরে হাফিজুর উঠেছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এস এম) হলে। থাকতেন দোতলার দক্ষিণ পাশের বারান্দায়। হলের বারান্দায় আরও অনেকে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে কে কোথায় থাকবেন, কে সিট পাবেন, কে পাবেন না—সেসব এখন আর হল প্রশাসন ঠিক করে না। ঠিক করেন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনটির ‘বড় ভাইয়েরা।’ বিএনপি আমলে ছাত্রদল, আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগ।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, হলে ওঠার বিনিময়ে হাফিজুরকে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে তালিম নিতে যেতে হতো। কিন্তু শীতের রাতের ধকল সইতে পারেননি তিনি। ফলে আক্রান্ত হন নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডে। চলে যান গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের পূর্ব শ্যামপুরে। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে ভালো চিকিৎসার জন্য রওনা দেন ঢাকায়। ১ ফেব্রুয়ারি রাতে পথেই তিনি মারা যান।
এই মৃত্যুর জবাব কী? এটি কি কেবলই শারীরিক অসুস্থতা, না এর পেছনে আমাদের অসুস্থ ছাত্ররাজনীতিও দায়ী? হাফিজুরের সহপাঠী ও পরিবারের অভিযোগ, শীতের মধ্যে বারান্দায় থাকা এবং রাতের বেলায় ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজ ঠান্ডায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় তীব্র শীতের মধ্যেও হাফিজকে গত ২৬ জানুয়ারি রাতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বাইরে থাকতে হয়। তাঁকে প্রায়ই অন্য কর্মীদের সঙ্গে হলের মাঠে ‘গেস্টরুম’ করতে হতো। গেস্টরুম হচ্ছে ছাত্রলীগের একটি দলীয় রীতি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রলীগের কনিষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠরা বসে আলাপ-আলোচনা করেন। এ সময় তাঁদের ছাত্রলীগ করতে বা হলে থাকতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দিদার মুহাম্মদ নিজামুল ইসলাম জোর করে হাফিজুরকে কর্মসূচিতে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ‘কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাকে বলত। কিন্তু সে এ নিয়ে আমাকে কখনোই কিছু বলেনি।’ দিদার হলে তুললেও ছাত্রলীগের অন্য কেউ যে হাফিজুরকে গেস্টরুম কর্মসূচিতে পাঠাননি, সে কথা হলফ করে বলা যাবে না। বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের নানা গ্রুপ থাকে। এক গ্রুপের কর্মীকে অন্য গ্রুপে নিতে জবরদস্তি করার ঘটনাও আছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হাফিজ আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। তাই যদি হয়, সেটি আরও গুরুতর। অসুস্থ অবস্থায় কে বা কারা তাঁকে রাতের ডিউটিতে পাঠিয়েছে, সেটি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
হাফিজুরের বাবা ইসহাক মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সপ্তাহের বুধবার হাফিজ ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিল। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “আমি আর বাঁচব না।” জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে। ও জানায়, শীতের মধ্যে বাইরে “ডিউটি” করতে হয়। ওই দিন নাকি সে ওদের বলেছে, তার শরীরটা ভালো না। ডিউটিতে যেতে পারবে না। কিন্তু তারপরও মাঠে নিয়ে গিয়ে রাত সাড়ে নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখেছে।’
একজন অসুস্থ তরুণকে রাত নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখা কী ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি? এসব যাঁরা করেন, তাঁরা কীভাবে নিজেদের সুস্থ রাজনীতির বাহক বলে দাবি করেন। নবীনদের ছাত্রসংগঠনে আনার জন্য তাঁরা সভা-সমাবেশ করে দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বোঝাতে পারেন। কিন্তু রাতের বেলায় চার ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে তালিম হবে কেন?
সন্তান হারিয়ে হাফিজুরের বাবা এখন দিশেহারা। মা পাগলপ্রায়। কিন্তু মা-বাবার আহাজারি আমাদের হৃদয়হীন সমাজকে এতটুকু নাড়া দিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ হল কিংবা হাফিজুর যে বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই বিভাগের সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। কেউ তাঁর মৃত্যুতে শোক জানায়নি। মা-বাবার খোঁজ নেয়নি। এমনকি যে ছাত্রসংগঠনটির নেতারা হাফিজুরকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছেন, সেই সংগঠনটিও তাঁর শোকাহত মা-বাবাকে সামান্য সমবেদনা জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি।
আবু বকর ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের শিকার হয়েছেন। হাফিজুর ছাত্র সংঘর্ষের শিকার না হলেও গেস্টরুম কর্মসূচির নামে চালু হওয়া অপসংস্কৃতিরই বলি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি এই তথাকথিত গেস্টরুম সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত? অবহিত হলে তারা এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? আর অবহিত না থাকলে হাফিজুরের মৃত্যুর দায় তারাও এড়াতে পারে না। শিক্ষার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে অবস্থানরত সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য করেছেন সলিমুল্লাহ হলের প্রাধ্যক্ষ। তাঁর দাবি, বারান্দায় থাকলেও নিউমোনিয়া হতে পারে, না থাকলেও হতে পারে। আরও অনেকে বারান্দায় ছিলেন, তাঁদের নিউমোনিয়া হয়নি; কিন্তু হাফিজুরের হয়েছে। প্রকারান্তরে তিনি হাফিজুরকেই তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন। দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষই বটে!
কয়েক বছর আগে শহীদুল্লাহ্ হলে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ার কারণে বেশ কিছু ছাত্রকে সারা রাত হলের বাইরে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেবার কর্তৃপক্ষ অন্যায়ের বিচার করলে হয়তো হাফিজুরকে শীতের রাতে নিউমোনিয়ায় ভুগে এভাবে মরতে হতো না।
হাফিজুরের গরিব বাবা জানেন, তিনি কখনো সন্তানকে ফিরে পাবেন না। তাই আকুতি জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে যেন আর কারও সন্তানকে হাফিজুরের ভাগ্য বরণ করতে না হয়। নিজের সন্তানের বিনিময়ে অন্যদের সন্তানকে নিরাপদ দেখতে চেয়েছেন এই মহান বাবা।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি সন্তানহারা বাবার এই আকুতি শুনতে পাবে? তারা কি ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে চলা অপসংস্কৃতি ও জবরদস্তি বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে? না প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনহীন ক্যাম্পাসে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সব অপকর্ম প্রশ্রয় দিতে থাকবে?
ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার মুক্তির দাবিতে নব্বইয়ের কয়েকজন ছাত্রনেতার বিবৃতির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এক অনুষ্ঠানে ক্যাম্পাসে লাশ ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নিকট অতীতে যাঁরা এই ক্যাম্পাসে লাশ ফেলেছেন, কাউকে কিন্তু সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিচারের মুখোমুখি করতে পারেনি।
আবু বকর সিদ্দিক হত্যার বিচার এবং হাফিজুরের মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তই পারে ক্যাম্পাসকে নিরাপদ রাখতে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.