রাজনৈতিক দলের সেকাল ও একাল by সৈয়দ আবুল মকসুদ

রাজনৈতিক দল কী এবং রাজনৈতিক নেতাদের কী কাজ, তা দেখে আসছে এ দেশের মানুষ বহু বছর থেকে। জীবনে আমি কোনো দলের কার্যালয়ে খুব কমই গিয়েছি। গেলেও গিয়েছি স্বাধীনতার আগে, কোনো নেতার সঙ্গে দেখা করতে। তবে কয়েকটি দলের কর্মকাণ্ড দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে। বড় নেতাদের কর্মকাণ্ড দেখেছি কাছে থেকে। যে দলকে আমি সমর্থন করেছি তার কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে বিশেষ ছিল না। গণতান্ত্রিক দলগুলোর জনসভায়ও উপস্থিত থেকেছি।
চিরকাল কোনো কিছু একই রকম থাকবে, তা আশা করা ঠিক নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আসে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে। পোশাক-আশাকে পরিবর্তন আসে। চালচলনে পরিবর্তন আসে। ৬০-৭০ বছর আগে এ দেশের বড় নেতারা পাম্প শু, ঢোলা পায়জামা, লম্বা কালো শেরওয়ানি এবং কালো টুপি পরতেন। পঞ্চাশের দশকে দেখেছি অধিকাংশ নেতাকে রাবারের জুতা, পায়জামা ও লম্বা শার্ট পরতে। সে শার্টও এখনকার শার্টের মতো নয়। তাতে পকেট থাকত তিনটি। দুই পাশে দুটি মস্ত বড় পকেট। তাতে অল্পস্বল্প বাজার করে রাখা যেত। সাধারণত ওই পকেটে তাঁরা রাখতেন টাকা-আধুলি ও খুচরা পয়সা। ওপরের বুকপকেটে থাকত কিছু কাগজপত্র, পাঁচ-দশটি টাকা এবং অবধারিতভাবে একটি ফাউন্টেন পেন। কেউ কেউ চশমাটা ভাঁজ করে বুকপকেটে রাখতেন। কারও কারও জামার বুকপকেট থাকত কলঙ্কিত—ফাউন্টেন পেনের বেরিয়ে পড়া কালির ছ্যাবড়ানো দাগ। কোনো কোনো নেতা পশ্চিম পাকিস্তানে যেতেন কারও থেকে একটা শেরওয়ানি ও জুতা ধার করে। ষাটের দশকে শার্ট-পায়জামা, প্যান্ট-শার্ট এবং পাঞ্জাবি-পায়জামা একই সঙ্গে চলত। মোটের ওপর এই ছিল বাহাত্তরের জানুয়ারির আগের পোশাকপরিচ্ছদের অবস্থা।
সুখ ও সমৃদ্ধি আসে সত্তরের দশক থেকে। একেবারে নিম্নমধ্য থেকে এক লাফে উচ্চ। পারমিট, টেন্ডার ইত্যাদি যাঁরা অতি দ্রুত হস্তগত করতে পেরেছেন এবং যাঁরা যথেষ্ট স্মার্ট, তাঁরা স্যুট-কোটে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। বঙ্গীয় রাজনীতির সঙ্গে পায়জামা-পাঞ্জাবির একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সত্তরের দশক থেকে ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি ও দামি টেট্রনের পায়জামা এবং তার ওপরে একটা হাতকাটা কটির মতো। যে ধরনের পোশাকে সুগঠিত দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধুকে নায়কোচিত লাগত, সেই পোশাকেই অনেক ভুঁড়িঅলা বা পাতলা লিকলিকে অনেককে কার্টুনের মতো মনে হতো। আশির দশক নাগাদ এ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের পোশাক-আশাক, বাড়ি-গাড়ি ও জীবনযাপনে যে পরিবর্তন আসে, তেমনটি আমেরিকায় আসতে ১০০ বছরের ওপরে লেগেছে। যানবাহনের প্রশ্নে পঞ্চাশের দশকে তো বটেই, ষাটের দশকেও ঢাকার অনেক নেতার অবলম্বন ছিল বাইসাইকেল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা যাতায়াত করতেন লঞ্চে বা ট্রেনে, প্রত্যন্ত এলাকায় নৌকায়। সত্তরের দশক পর্যন্ত দেশের রাস্তাঘাটও ছিল শোচনীয়। যোগাযোগের অসুবিধা সত্ত্বেও দেশের সব অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে নেতাদের সম্পর্ক সৃষ্টি হতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে।
এখন কেউ ভাবতেও পারবে না সদরঘাট মোড় থেকে টাউন সার্ভিস বাস ইসলামপুর, মিটফোর্ড, চকবাজার, লালবাগ, আজিমপুর হয়ে নিউমার্কেট-নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত চলত। পঞ্চাশের দশকে ওই রুটে আমরা বাসে, রিকশায়, সাইকেলে বা হেঁটে বাংলাবাজার থেকে আজিমপুর-লালবাগ আসতাম। মিটফোর্ড পার হয়ে মোগলটুলী-চকবাজার এলে আব্বা আমাকে দেখাতেন একটি বাড়ি। ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। ইতিহাসের সাক্ষী। ওই বাড়িতে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের প্রক্রিয়ার শুরু। তারপর টিকাটুলী কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেন’ নামক বাড়িতে দলের আত্মপ্রকাশ। পঞ্চাশের দশকে এবং ষাটের প্রথম কিছুকাল আওয়ামী লীগের কার্যালয় ছিল নবাবপুরে। কোনো জৌলুশ ছিল না, কিন্তু তা মুখরিত থাকত বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের আনাগোনায়। তারপর অফিস আসে পুরানা পল্টন। সবশেষে গুলিস্তান-জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ওই সব কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নেতা ও দলীয় সাধারণ কর্মীদের মধ্যে অবাধে মেলামেশা হতো। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা সবার নাম টুকে রাখতেন তাঁদের খাতায়। ঝুঁকি নিয়ে নিচের দিকের নেতারা দলীয় কার্যালয়ে যাতায়াত করতেন।
এক দল থেকে আরেক বা একাধিক দলের জন্ম হতে পারে। সেটা স্বাভাবিক। তাকে দলের ভাঙন বলে না। কোন্দলও বলে না। ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই আওয়ামী লীগ থেকে বামপন্থীরা বেরিয়ে অন্য আরও কয়েকটি দলকে নিয়ে গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সন্তোষের লুঙ্গি-পরা এক বৃদ্ধের নেতৃত্বে। প্রথমে অফিস ছিল না। লিয়াকত অ্যাভিনিউর রয়েল স্টেশনারির ওপরে ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের বাড়িতেই দলের কাজ চলত। সন্তোষের বৃদ্ধও ওই বাড়িতে এসে উঠতেন। ঢাকায় তাঁর অস্থায়ী বা স্থায়ী বাসা বা বাড়ি ছিল না। টিপু সুলতান রোডে ‘স্টেপ-ইন’ নামক এক বাড়িতেও উঠতেন। কখনো মগবাজারে সাইদুল হাসানের (একাত্তরে শহীদ) বাড়িতে।
পরে ন্যাপের অফিস হয় নবাবপুর-ঠাটারিবাজারের কাছে ‘নাইল ভ্যালি’ হোটেলের দোতলায়। সেখানেই থাকতেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করা কৃষকনেতা হাজী দানেশ, হাতেম আলী খান প্রমুখ। হাজী দানেশ নিজের হাতে ডাল, ভাত, তরকারি রান্না করে খেতেন এবং ন্যাপ কর্মীরা গেলে তাঁদেরও খেতে দিতেন। ন্যাপকে বাইরে থেকে নানাভাবে আর্থিক সাহায্য করতেন ডাক্তার আবদুল ওয়াদুদ, জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের সঙ্গেও সাইদুর রহমান স্যারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
সেকালের আর একটি প্রধান দল কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো। এখনকার তরুণেরা মনে করবে গুল মারছি। পুরানা পল্টনে ছিল ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়। সেখানে থাকতেন জ্ঞান চক্রবর্তী, খোকা রায়, সুনীল রায়, অনিল মুখার্জি। কোনো দিন লক্ষ্মীবাজার থেকে হেঁটে আসতেন রণেশ দাশগুপ্ত। খোকা রায় সকালে উঠে পার্টির অফিস নিজের হাতে ঝাড়ু দিতেন। মাছ-তরকারি কুটে রান্নাবান্নাও করতেন। আমাদের মতো নির্বোধ ছোকরারা ওই সব বিষয়বুদ্ধি-বিবর্জিত নেতার কথা শুনতাম আর ভাবতাম, এই বুঝি দেশটায় বিপ্লব এল আর বদলে গেল পুরোনো সমাজটা।
এখন সকালবেলা খবরের কাগজ পড়ে এবং সন্ধ্যাবেলা টিভি চ্যানেলে খবর শুনে পুরোনো দিনের সব আজেবাজে স্মৃতি মাথার মধ্যে জড়ো হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি ছিল রাজনৈতিক দল। নেতারা ছিলেন জনগণের নেতা। রাজনৈতিক দল ডিপার্টমেন্ট স্টোর বা হাঁস-মুরগি বা গরু-ছাগলের খামারের মতো প্রতিষ্ঠান নয়। দলের নেতা ইচ্ছামতো একে বরখাস্ত ওকে নিযুক্তি দিতে পারেন না ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিক বা চেয়ারম্যানের মতো। রাজনৈতিক দলের অফিস আর কোনো কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভের কার্যালয় এক রকম নয়।
৫০-৬০ বছর আগে ধড়িবাজ-বাটপার ধরনের লোকের রাজনীতিতে স্থান ছিল না। সেখানে রাজনীতিই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, দলের আলিশান কার্যালয় নয়। তখন ‘আসল’ দলের লোকেরা নকল দলের অফিস দখল করতে ট্রাক নিয়ে দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের মতো অভিযানে বের হতেন না। তারপর ধাওয়া–পাল্টাধাওয়া, মারপিট ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ। দাউ দাউ করে জ্বলছে ট্রাক আর তার সওয়ারিরা ভোঁ-দৌড় দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে ভাঙছেন হাঁটু।
রাজনীতি আর মন্ত্রিত্ব, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, সংসদে বিরোধী দলের নেতৃত্ব—সবই একসঙ্গে ককটেল বানানো শুধু কলিযুগেই সম্ভব। ধারণা করা যায় কি কোনো দেশে বিরোধী দলের কোন্দল মেটাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হচ্ছে? ভাবা যায়, আওয়ামী লীগ বা ন্যাপের নেতারা নিজেদের বিরোধ মেটাতে গভর্নর মোনায়েম খানের শরণাপন্ন হচ্ছেন? মন্ত্রিত্ব বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা না নিয়ে বাইরে থেকে সরকারকে সমর্থন দিলে তা হতো সততা। ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করার নাম রাজনীতি নয় এবং জনগণকে ছাগল মনে করা ঘোরতর অন্যায়। কামরুল হাসানের জীবনের শেষ ছবিটির কথা মনে পড়ে, যার ক্যাপশন: দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার কবলে। কী অমোঘ সত্য কথা বলেছেন নেতা: ‘আওয়ামী লীগ তার প্রয়োজনেই জাপাকে শক্তিশালী করবে।’
একজনের ১০টি বছর মন্ত্রিত্ব করেও সাধ মেটেনি। এখন আবার সরকারি দলে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাঁড়া। শুধু হাতছানির হাতটা নড়তে দেখলেই হয়। আগে নেতাদের দেখেছি দল শক্তিশালী করাকে মন্ত্রিত্বের চেয়ে সম্মানজনক মনে করতেন। ১৯৫৭-তে শেখ মুজিব মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়াই বড় দায়িত্ব মনে করেছেন। মনে আছে, ১৯৭৪-এ এ এইচ এম কামারুজ্জামান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর জায়গায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন ও পানিসম্পদমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাককে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে এখন বিরোধী দলের পরিচয় দিয়ে মন্ত্রিত্ব কামড়ে পড়ে থাকা নির্লজ্জতা নয় কি?
বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দুটোরই জন্ম ক্ষমতাসীন অবস্থায়। তাই সরকারের বাইরে থেকে যে রাজনীতি হয়, তা মানতে তারা বাধ্য নয়। কোনো দলের জাতীয় কাউন্সিল অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাতে পূর্ববর্তী বছরগুলোর নেতাদের কাজের মূল্যায়ন হয় এবং আগামী বছরগুলোতে নতুন নেতৃত্ব কী করবেন, তা ঠিক করা হয়। দল যদি প্রাইভেট কোম্পানিতে পরিণত হয় তাহলে এক কাউন্সিল থেকে আরেক কাউন্সিল থোড় বড়ি খাড়া—খাড়া বড়ি থোড় মাত্র।
বিএনপি যদি ডান্ডি ডাইংয়ের আর একটি ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, তাহলে মার্চে কাউন্সিল করেও লাভ নেই, বরং ২০১৯-এর মার্চে গিয়ে করলেই ভালো। স্মৃতি থেকে যেটুকু মনে পড়ে, বিএনপির কোনো মহাসচিবই স্বাধীনমতো কাজ করা শুধু নয়, পুরো মেয়াদ পার করতে পারেননি। হয় পরপারে গেছেন, নয়তো পদ থেকে হয়েছেন বরখাস্ত। মান্নান ভূঁইয়ার প্রতি খালেদা জিয়া ভদ্রজনোচিত আচরণ করেননি। কে এম ওবায়দুর রহমান ভালো নেতা ছিলেন। এক রাত আগেও জানতেন না যে তিনি পদ হারাচ্ছেন। দলের সেক্রেটারি বানাতে হয় তরুণ ও দক্ষ নেতাকে। বুড়োরা ইমামতি করতে পারেন, দলের নেতৃত্ব নয়। মির্জা আলমগীরের মতো একজন অসাম্প্রদায়িক ভদ্র ও প্রগতিশীল নেতাকে শুধু ভারই বহন করতে হলো।
তবু আশা করি, নেতারা শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবেন। বাংলাদেশের পথভ্রষ্ট রাজনীতি তার অতীত ঐতিহ্য থেকে শিক্ষা নেবে এবং এ বছর স্বাভাবিক ধারায় ফিরে এসে মানুষকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.