সময় শ্রম মেধা নেতৃত্ব by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তথা সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে। আফ্রিকার উত্তর অংশ ছিল একটি বিশাল রণাঙ্গন। একাধিক ব্যক্তি মিত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন; তবে এখানে একজনের নাম উল্লেখ করছি তিনি হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মন্টগোমারি। তখনকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (বর্তমানের বাংলাদেশ-উত্তরপূর্ব ভারত-বার্মা-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর) ছিল একটি বিশাল রণাঙ্গন। এই রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল উইলিয়াম স্লিম। মন্টগোমারি এবং স্লিম উভয়েই সফল সেনাপতি ছিলেন; কালক্রমে চার তারকা জেনারেল হয়েছিলেন; উভয়েই সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ র‌্যাংক ‘ফিল্ড মার্শাল’-পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন; উভয়েই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। মন্টগোমারি এবং স্লিমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বা কর্মপদ্ধতির দু’টি আঙ্গিক উল্লেখ করছি। আফ্রিকার উত্তর অংশে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার দ্বিতীয় বছরের শেষাংশে, মন্টগোমারি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন, মিত্রবাহিনী পরাজিত হতে হতে নাস্তানাবুদ অবস্থায়; তাদের মনোবল একদম নিচে। মন্টগোমারি দিনভর কাজ করতেন। রাত ৮টার দিকে রাতের খাবার খেতেন এবং ৯টার মধ্যে নিজের ‘ক্যারাভান’ বা অস্থায়ী বাঙ্ঘরের মধ্যে ঢুকে যেতেন রাতের বিশ্রামের জন্য। পরের দিন সকাল ৮টার দিকে নাস্তা খেতেন। রাতে মন্টগোমারি কিছুক্ষণ বাইবেল পড়তেন, কিছুক্ষণ হালকা কিছু পড়তেন, কিছুক্ষণ যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করতেন এবং বাকি সময়টুকু ঘুমোতেন। অধীনস্থ সব স্টাফ অফিসার ও কর্মকর্তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ ছিল যে, তারা যেন মন্টগোমারিকে রাতের খাবারের পর এবং সকালের নাস্তার আগে কোনো বিষয়ে বিরক্ত না করেন। একজন মধ্যপর্যায়ের স্টাফ অফিসার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, স্যার, রাতে যদি শত্রু আমাদের অবস্থানের ওপর এমন কোনো প্রকারের আক্রমণ করে যে আমাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলেও কি আপনাকে জানাব না? তার উত্তরে মন্টগোমারি বলেছিলেন না, জানাবে না। কারণ সারা দিনও যদি তোমরা বুঝতে না পারো যে, শত্রু রাতে এটা করতে পারে, তা হলে আসলেই তোমরা অযোগ্য এবং তোমাদের আমার স্টাফ অফিসার হিসেবে রাখাটাও আমার জন্য অযোগ্যতা। তোমার অযোগ্যতার জন্য তুমি মরবে এবং আমার অযোগ্যতার জন্য আমি মরব। তখন আমরা বার্মায় আসি। বার্মার বর্তমান নাম মিয়ানমার। ৪ জানুয়ারি ২০১৬ সকালে ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের এপি সেন্টার বা মূল উৎপত্তিকেন্দ্র ছিল ইম্ফল নামক একটি নগরীর অতি কাছে। ঢাকা থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এবং সিলেট থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে ইম্ফল নগরী অবস্থিত। উত্তর-পূর্ব ভারতে যে সাতটি প্রদেশ আছে, তার মধ্যে অন্যতম মনিপুরের রাজধানী হচ্ছে ইম্ফল। ১৯৪২ সালের শেষ দিকের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম অংশীদার দেশ ছিল জাপান। জাপানিরা বঙ্গোপসাগর দিয়ে এসে বার্মার উপকূলে নামে। রেঙ্গুন শহর দখল করে এবং উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ব্রিটিশ বাহিনী পেছনে, অর্থাৎ উত্তর দিকে হটতে হটতে পর্যুদস্ত হয়ে যায়; তাদের মনোবল একদম নিচে নেমে যায়। ওই সময় লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্লিমকে সেনাপতি বানিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি খোলামেলা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি বলতেন, আমার অফিস এবং আমার আবাসস্থলের দরজা দিন এবং রাতের সব ঘণ্টা এবং মিনিটে, সবার জন্য খোলা। তিনি বলতেন, এটা যুদ্ধক্ষেত্র এবং এখানে চব্বিশটা ঘণ্টাই আমরা যুদ্ধে লিপ্ত। বিশ্রামের কাজ সেটাও যুদ্ধের অংশ। বিশ্রাম নেবো এই অজুহাতে সিদ্ধান্ত প্রার্থনা করা বা সিদ্ধান্ত দেয়া যেন বিলম্বিত না হয় এটা আমাদের খেয়াল করতে হবে। সম্মানিত পাঠক, খেয়াল করুন যে, দুজন অতি বিখ্যাত সফল সেনাপতি মন্টগোমারি এবং স্লিম একেবারেই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন। দু’জনই ইতিহাসে বিখ্যাত। সম্মানিত পাঠক, আপনারা যুদ্ধের ময়দানে ব্যস্ত নয়। তারপরও মনে করুন যে আপনারা মধ্যপর্যায়ের সেনা অফিসার। জেনারেল মন্টগোমারি এবং জেনারেল স্লিমের মধ্যে কার বৈশিষ্ট্যকে বেশি পছন্দ করবেন? খুবই কঠিন প্রশ্ন। উত্তর নির্ভর করবে আপনার নিজের বৈশিষ্ট্যের ওপর। এই উদাহরণগুলো সেনাবাহিনী থেকে দিলাম কিন্তু বৈশিষ্ট্য বা প্রবণতাগুলো ব্যবসা ও রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিভাবে প্রযোজ্য সেটা আপনি চিন্তা করলেই পাবেন। মন্টগোমারি এবং স্লিম উভয়েই সাফল্য উপহার দিয়েছিলেন; তাই ইতিহাস উভয়কেই সম্মানিত করছে। যদি একজন সাফল্য না দিতেন এবং অপরজন দিতেন, তাহলে ইতিহাস এবং গবেষকেরা, যিনি সাফল্য দিয়েছিলেন তাকেই বাহবা দিতেন এবং তার বৈশিষ্ট্যকেই সম্মান করতেন। যিনি সাফল্য না দিতেন, তার বৈশিষ্ট্যকে তিরস্কার করতেন। এই উভয় নেতা তাদের কাছে মজুদ সৈন্য সংখ্যা, তাদের অধীনস্থ অফিসারদের মেধা, তাদের সামনে পড়ে থাকা ‘সময়’, তাদের বিপরীতে শত্রু বাহিনীর কর্মপদ্ধতি ও চিন্তাভাবনা ইত্যাদিকে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই তারা সফল হয়েছিলেন। ইতিহাসের একটি কঠোর বাক্য উল্লেখ করে এই অনুচ্ছেদ শেষ করছি। বাক্যটি হলো- ‘সাকসেস হ্যাজ মেনি ফাদারস; ফেইলিউর ইজ এন অরফ্যান।’ বাংলায় ভাবার্থ দাঁড়াবে অনেকটা এরকম : ‘সন্তানের সাফল্যের কৃতিত্ব নেয়ার জন্য অনেকেই বাপ হিসেবে সামনে আসবে, সন্তানের ব্যর্থতার দায়িত্ব নেয়ার জন্য কোনো বাপ পাওয়া যাবে না। কারণ বলা হবে যে, ছেলেটি এতিম।’ এখন আমরা সময় এবং মেধা নিয়ে কিছু কথা বলব।
সময়ের কাজ এবং নেতার কাজ
নয়া দিগন্তে বুধবার ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ প্রকাশিত কলামের নাম ছিল ‘পরিকল্পিতভাবে সময়ের ব্যবহার’। ওই কলামের শেষাংশ থেকে কয়েকটি বাক্য এখানে রিপিট করছি। উদ্ধৃতি শুরু। সময় প্রসঙ্গ। সময়ের সাথে সম্পর্ক ঘড়ির। ঘড়ি অন্ততপক্ষে তিন প্রকার- দেওয়াল ঘড়ি, টেবিল ঘড়ি ও হাতঘড়ি। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নির্বাচনী প্রতীক হলো হাতঘড়ি। সোয়া আট বছর আগে এই প্রতীক দাবি করার সময় নিজের অন্তরে একটি সিদ্ধান্ত ছিল, সিদ্ধান্তটি হলো এরূপ : যেদিন সমগ্র বাঙালি জাতি বা বাংলাদেশী ঘড়ি ধরে চলাচল করতে অভ্যস্ত হবে, সেদিন আমাদের কোনো কিছুতেই কেউ ঠেকাতে পারবে না। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয় এবং কোন কাজের জন্য কোন সময়টি উপযুক্ত সেটাও সময়মতো নির্ধারণ করতে হয়।... সময়মতো কাজ করতে গেলে অনেক উপাদান লাগে। যথা শ্রম, অর্থ ও মেধা। এসব উপাদান একত্র করে উপকার পেতে হলে শক্তিশালী অনুঘটক লাগে। সেই অনুঘটকের নাম নেতা বা নেতৃত্ব। নেতার কাজ চিন্তা করা, পরিকল্পনা করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গ্রিন সিগন্যাল দেয়া। একবার কাজ শুরু হয়ে গেলে নেতার কাজ কাজের অগ্রগতি মনিটর করা। উদ্ধৃতি শেষ। আজকের কলামে উপাদান শ্রম, অর্থ, মেধা ইত্যাদি সম্পর্কে লিখব।
শ্রম এবং শ্রমিকের প্রকারভেদ
শ্রম যিনি দেন তিনি শ্রমিক। শ্রম অন্তত দুই প্রকার- কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রম। একজন ছাত্র পরীক্ষার আগে দুই প্রকার শ্রম দেয়। পরীক্ষা সামনে রেখে, সময়ের স্বল্পতাকে বিবেচনায় রেখে বুদ্ধি খরচ করে নির্ধারণ করে কোনটুকু পড়বে, কখন পড়বে? এটা হলো মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম। ওই ছাত্রকেই পড়ার জন্য, পড়ার চেয়ার-টেবিলে সশরীরে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। এটা দৈহিক শ্রম। অনেক ছাত্রই প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টারে গিয়ে পড়ে। কোচিং সেন্টারের শিক্ষক বা বাড়িতে এসে পড়ানো প্রাইভেট টিউটর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ছাত্রদের দেখিয়ে দেন, কোনটা কখন পড়লে সময় এবং পরিশ্রম সাশ্রয় হবে। এই নির্দিষ্ট আলোচনা এগিয়ে নেয়ার আগে একটি বাস্তব উদাহরণ দিই। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝির কথা। আমি তখন ঢাকা মহানগরের উত্তর-পশ্চিমাংশের মিরপুর সেনানিবাসে ‘ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ’-এ একজন প্রশিক্ষক। বছরে চারটি সেমিস্টার হতো। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে তৃতীয় সেমিস্টার চলাকালে ছাত্রদের নিয়ে তিন রাত চার দিনের জন্য দূরে যাওয়া হতো সামরিক অনুশীলনের জন্য। সারা দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার পর সারারাত ধরে ছাত্রদের পরিস্থিতির মূল্যায়ন (সামরিক পরিভাষায় : এপ্রেসিয়েশন অব দি সিচুয়েশন) লিখতে হতো। সকাল ৬টায় মূল্যায়নপত্র জমা দিতে হতো। মূল্যায়ন লেখার সময় গভীর রাতে ঝিমুনি আসবে দেখে ছাত্ররা এক গামলা ঠাণ্ডা পানি নিতো এবং ওই গামলার মধ্যে পা ভিজিয়ে রাখত। মশা কামড়াবে দেখে ধূপ জ্বালিয়ে রাখত। অর্থাৎ বসে বসে শ্রম দেয়ায় যে কষ্টের কাজ সেটাই বোঝাতে চাইলাম। আলোচনায় ফিরে যাই। এরূপ সময়ের চাপ দিয়ে, শারীরিক কষ্ট দিয়ে, ছাত্রদের কাজ করানোর উদ্দেশ্য হতো, যুদ্ধের ময়দানে এই অফিসারেরা যেন পরিশ্রান্ত অবস্থায় চিন্তাভাবনা করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার প্র্যাকটিস করানো। অন্য উদাহরণে যাই। নির্মাণশ্রমিকেরা মাথায় করে ইট এবং সিমেন্টের বস্তা টানেন, ঢাকা মহানগরের সদরঘাটে অথবা চট্টগ্রাম মহানগরের চাক্তাইয়ে অথবা মেঘনা নদীর তীরে চাঁদপুরে শ্রমিকেরা নৌকা বা লঞ্চ বা বার্জ থেকে মালামাল মাথায় করে নামিয়ে তীরে আনেন। এটা দৈহিক শ্রম। ঢাকা মহানগরের মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ৫০০ রাজনৈতিক কর্মী রাজপথ দিয়ে স্লোগান দিতে দিতে হেঁটে নয়া পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে এলেন, এটা হচ্ছে দৈহিক শ্রম। বড় রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতা দেবেন, সেজন্য শ্রোতামণ্ডলী মাঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন এটা যুগপৎ মানসিক এবং দৈহিক শ্রম। কোথায় শ্রম দিতে হবে, কখন দিতে হবে, কতটুকু দিতে হবে এটা নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নির্ধারণ করার দায়িত্ব শ্রমদাতার একলা নয়; যিনি নেতা, তারও দায়িত্ব। কারণ, কত কম শ্রমে কত বেশি ফল অর্জন করা যায় সেটা নির্ধারণ করাই হচ্ছে নেতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাজনৈতিক কর্মীর শ্রমের আরো উদাহরণ আছে। মিটিংয়ে যাওয়া, দলীয় বই-পুস্তক পড়া, দলীয় ব্যক্তিদের কথাবার্তা শোনা, টেলিভিশনের নিউজ দেখার মাধ্যমে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকা, সমমনা রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখা ইত্যাদি সবই শ্রম দেয়ার উদাহরণ। আমাদের দেশে আমরা শ্রমিক বলতে শুধু কৃষি ক্ষেত্রে বা শিল্পকারখানায় যারা দৈহিকভাবে কাজ করেন তাদেরই বুঝাই। এটা অর্ধেক-বাস্তব। কিশোর-কিশোরী বা বয়স্ক গৃহকর্মীরাও শ্রমিক। গাড়ি চালনার ড্রাইভারও শ্রমিক। মসজিদ বা মন্দির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য যিনি শ্রম দেন তিনিও শ্রমিক। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও শ্রম দেন এবং বৃহত্তর আঙ্গিকে তাদেরও শ্রমিক বলা যাবে। একজন সৈনিক বা একজন সামরিক অফিসারকে শান্তিকালে বা যুদ্ধের মাঠে অনেক শ্রম দিতে হয় এবং সেই আঙ্গিকে তারাও শ্রমিক। শ্রমের মর্যাদা দেয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকের শ্রম ছাড়া বর্তমান সভ্যতা গড়ে উঠতে পারত না। ইতিহাসের একটি তথ্য অনেকের মনে আছে যে, বিশ্ববিখ্যাত তাজমহল বানাতে ২০ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল।
রাজনৈতিক কর্মীর দক্ষতা ও অদক্ষতা
শ্রমিকদের অনেক প্রকারে ভাগ বা পরিচিত করা যায়। তবে একটি প্রকার হলো দক্ষতার ভিত্তিতে অর্থাৎ দক্ষ শ্রমিক ও অদক্ষ শ্রমিক। ইংরেজি পরিভাষায় স্কিল্ড লেবার এবং আনস্কিল্ড লেবার। স্কিল্ড লেবারের বেতন বেশি এবং উন্নয়নগামী দেশে তাদের চাহিদা বেশি। আনস্কিল্ড লেবারের চাহিদা থাকলেও বেতন কম। একটি কঠিন প্রশ্ন, রাজনীতির অঙ্গনে কি স্কিল্ড এবং আনস্কিল্ড শব্দটি প্রযোজ্য? অর্থাৎ স্কিল্ড রাজনৈতিক কর্মী এবং আনস্কিল্ড রাজনৈতিক কর্মী- এ ধরনের পরিচয় কি প্রযোজ্য? এ প্রসঙ্গে আলোচনা আরেক দিন করব। তবে এই অনুচ্ছেদের উপসংহারে বলতেই হবে যে, রাজনীতির অঙ্গনেও শ্রম না দিলে কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক অগ্রগতি বা প্রমোশন হবে না; তেমনি ওই দলেরও কোনো অগ্রগতি হবে না। রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষ থেকে দেয়া শ্রমের উদাহরণ ওপরে দিয়েছি।
মেধার প্রয়োজন ও মেধা যাচাই
মেধা ব্যতিত অনেক কাজ সম্ভব নয়। ওপরের অনুচ্ছেদের শ্রম ও শ্রমিক প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছি স্কিল্ড এবং আনস্কিল্ড লেবারের কথা। শুরুতে সব শ্রমিকই একরকম থাকে; কিন্তু যাদের মেধা আছে তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য যোগ্য হয় এবং তারা স্কিল্ড লেবার হয়। মেধার প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব সব ধরনের পেশায় আছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বেশির ভাগ পেশা বা কর্মযজ্ঞে প্রবেশের জন্য মেধার প্রয়োজন এবং পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই হয়। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে, মেডিক্যাল পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই হয়। চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা হয়। আদালতে আইনজীবী হিসেবে পেশা শুরু করার আগে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতা যাচাই হয়।
সেনা অফিসার হওয়ার জন্য পরীক্ষা
সামরিক বাহিনীতে অফিসার হিসেবে ঢোকার জন্য ব্যতিক্রমধর্মী পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা বা যোগ্যতা যাচাই হয়। এই পর্যায়ে সেনাবাহিনীতে অফিসার হওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া তার উদাহরণ টানছি। কারণ এটার সাথে এই কলামের পরবর্তী আলোচনার কিছুটা সম্পর্ক আছে। প্রথমে দরখাস্ত করতে হয়। তারপর সেনানিবাসে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে গিয়ে প্রাথমিক মৌখিক পরীক্ষা ও প্রাথমিক ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে হয়। যারা পাস করে, তারা কিছু দিন পর লিখিত পরীক্ষা দেয়। তাতে যারা পাস করে তাদের কিছু দিন পর ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ডের (বাংলা অনুবাদ দাঁড়াবে ‘আন্তবাহিনী নির্বাচনী পর্ষদ’) সামনে যেতে হয়; এর সংক্ষেপ হলো আইএসএসবি। আইএসএসবিতে পরীক্ষা দুই ধাপের। প্রথম ধাপ শেষ হয়ে যায় প্রথম দিনের প্রথম পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে। এই প্রথম ধাপ মূলত বুদ্ধির পরীক্ষা বা আইকিউ টেস্ট এবং প্রাথমিক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা। যারা প্রথম ধাপ পাস করে, তারা দ্বিতীয় ধাপে পরবর্তী আরো প্রায় ষাট ঘণ্টা থাকে। গ্রুপ টেস্টিং অফিসারদের (সংক্ষেপে জিটিও) তত্ত্বাবধানে মাঠে পরীক্ষা চলে দুই সকাল। মনস্তত্ত্ববিদদের তত্ত্বাবধানে ইনডোর বা ঘরের মধ্যে পরীক্ষা চলে একটি পুরো বিকাল। কোনো একসময় আধা ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টাব্যাপী একটি মৌখিক পরীক্ষা হবে প্রত্যেকের জন্য। আইএসএসবিতে পরীক্ষাটিকে ত্রিমাত্রিক বা থ্রি-ডাইমেনশনাল বলা যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আইএসএসবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। তার আগে শুধু সেনাবাহিনীর জন্য সিলেকশন বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের আগস্টে। সাধারণত আইএসএসবি পরীক্ষার মেয়াদ সাড়ে তিন দিন; পরীক্ষা শেষে দেখা যায় যে, নির্বাচিত বা পাস করা তরুণের সংখ্যা কম; নির্বাচিত হয়নি বা পাস করেনি এমন তরুণের সংখ্যা বেশি। এটা আপাতত খুবই একটি বেদনাদায়ক তথ্য। সতেরো আঠারো উনিশ বছরের কিশোর বা তরুণেরা যখন মনোনীত হয় না, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মন খারাপ থাকে। তাদের একটা কথা নির্বাচকেরা আন্তরিকভাবে বোঝাতেন এবং এখনো বোঝান। ওই কথাটি আমি এখানে উদ্ধৃতির মধ্যে উল্লেখ করছি। ‘আপনি সেনাবাহিনীতে অফিসার হওয়ার নিমিত্তে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হননি। এর মানে এই নয় যে, আপনি অমেধাবী বা আপনি সার্বিকভাবে অযোগ্য একজন কিশোর বা তরুণ। বরং এটা বলাই শ্রেয় যে, আপনার মেধা বা আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো সেনাবাহিনীর অফিসারের জন্য উপযুক্ত না হলেও, অন্য যেকোনো একটি ভালো পেশার জন্য উপযুক্ত। আপনি হয়তো ভালো ডাক্তার হবেন অথবা ভালো প্রকৌশলী হবেন অথবা ভালো জনসংযোগ কর্মকর্তা হবেন অথবা ভালো মার্কেটিং কর্মকর্তা হবেন অথবা ভালো গবেষক হবেন। আপনি মনোবল হারাবেন না। আপনি এগিয়ে যান।’
রাজনীতিতে মেধার প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
উপরের দীর্ঘ বর্ণনার পর এই অনুচ্ছেদের এই স্থানে আমার পক্ষ থেকে যে প্রশ্নটি উপস্থাপন করছি সেটি হলো, রাজনীতির অঙ্গনে মেধার কোনো প্রয়োজন আছে কি না, থাকলে কতটুকু এবং কোন আঙ্গিকে প্রযোজ্য? বাংলাদেশের বর্তমান সার্বিক রাজনৈতিক অঙ্গনে মেধার মূল্য, মেধাবীদের আকর্ষণ করার প্রক্রিয়া এবং মেধাবীদের কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া কতটুকু সুষ্ঠু, কতটুকু সক্রিয়, কতটুকু স্বাগতম ইত্যাদি অবশ্যই মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। রাজনীতি যেহেতু এমন একটি পেশা, যা অন্য সব পেশা ও কর্মযজ্ঞকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবান্বিত করে। অতএব, রাজনীতির অঙ্গনে মেধাকে যথাযথভাবে স্বাগতম জানানো, পুষ্টি ও পানি দিয়ে সবল করা এবং কাজে লাগানো অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।
উপসংহার
গত বুধবার ২০ জানুয়ারি আমার লেখা কলাম প্রকাশিত হয়নি। কারণ ঠিক একদিন আগে ১৯ জানুয়ারি আমার ভিন্নধর্মী কলাম বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের জীবনকর্ম বের হয়েছিল। যা হোক, দুই সপ্তাহ আগে, বুধবার ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ প্রকাশিত কলামে সর্বশেষ অনুচ্ছেদে আমরা বলেছিলাম, ‘সময় মতো কাজ করতে গেলে অনেক উপাদান লাগে। যথা শ্রম, অর্থ ও মেধা। এসব উপাদান একত্র করে উপকার পেতে হলে শক্তিশালী অনুঘটক লাগে। সেই অনুঘটকের নাম নেতা বা নেতৃত্ব।’ এই চারটি উপাদান- সময়, শ্রম, অর্থ ও মেধা সম্পর্কে আলোচনা গত সপ্তাহেও করেছিলাম, এই সপ্তাহেও করলাম। আশা করি আগামী দুই সপ্তাহও করব। আলোচনার উদ্দেশ্য- যেন সামাজিক অঙ্গনে, ব্যবসায়িক অঙ্গনে, রাজনীতির অঙ্গনে এগুলোর ব্যবহার এবং ব্যবহারের পর ফলাফল প্রসঙ্গে আমাদের সচেতনতা বাড়ে।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:), চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

No comments

Powered by Blogger.