উন্নয়নে বগুড়াবাসীর স্বস্তি ও প্রত্যাশা by তুহিন ওয়াদুদ

গত মাসে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ওঁরাওদের জাতীয় শিক্ষা সম্মেলন ২০১৬-এ সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় গিয়েছিলাম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সহস্রাধিক ওঁরাও শিক্ষার্থী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নিজ জেলা সিরাজগঞ্জকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কী কী করেছেন এবং করতে চান, তা উল্লেখ সাপেক্ষে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে গিয়েছিলাম বগুড়ায়। নগরের বনানীর পথ ধরে বগুড়া শহরে প্রবেশ করার সময়ে চার লেনের বিশাল সড়ক আর সড়ক বিভাজনের মাঝখানের সবুজ গাছ শোভিত দৃশ্য শহরের উন্নয়ন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয়। এ জেলার উন্নয়নেও নিজ জেলার রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ ভূমিকাই মুখ্য। জেলা শহর হিসেবে বগুড়া শহরের ভৌত অবকাঠামো অনেক উন্নত।
করতোয়া-নাগর-যমুনা-বাঙ্গালী নদীবিধৌত বগুড়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। কিংবদন্তিতুল্য বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বগুড়ার মহাস্থান গড়ে অবস্থিত। পাল রাজাদের আমলেও এখানে অনেক বিহার গড়ে উঠেছিল। নিহাররঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ (আদিপর্ব)-এ উল্লেখ করেছেন, ‘খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক দ্বিতীয় শতকের মহাস্থান-ব্রাহ্মী লিপিতে এক পুন্দনগল বা পুণ্ড্রনগরের উল্লেখ আছে। এই পুন্দনগলই বোধ হয় ছিল তদানীন্তন পুণ্ড্রের রাজধানী বর্তমান বগুড়া জেলার মহাস্থান, যাহার পুরোনো ধ্বংসাবশেষ ঘেঁষিয়া এখনো করতোয়ারÿ ক্ষীণধারা বহমান।’
উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর দুই বিভাগের মধ্যে বগুড়ায় দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং বিশব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে দারিদ্র্যের গড় হার ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ হলেও বগুড়ায় এই হার মাত্র ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বগুড়ায় দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা কিছু শিল্প-কারখানা এখানকার উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। বগুড়ায় বিশেষত কৃষি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ তৈরির অনেক কারখানা রয়েছে। সাবান কারখানার জন্য বগুড়ার খ্যাতি আছে। রবিশস্য উৎপাদনের জন্যও মাটি খুবই উপযোগী।
বগুড়ার সন্তান জিয়াউর রহমান। তিনি নিজে সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল। তবে বৃহৎ উন্নয়ন হয়েছে শেষবারের ক্ষমতায়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে। এ সময়ে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, শিশু হাসপাতাল, এয়ারপোর্ট, শহরের মধ্যে চার লেন সড়ক, সড়ক বিভাজনের মধ্যে দৃষ্টিনন্দন গাছ, বাইপাস সড়ক, পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস-সংযোগসহ অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ভবনও সেই সময়ে শুরু হয়। আবার সেই সময়েই বগুড়ায় জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই তৈরি হয়।
বগুড়া শহরের উন্নয়নে যে সরকারই ভূমিকা রাখুক না কেন, সুবিধা ভোগ করছে বগুড়ার সর্বস্তরের নাগরিক।
বগুড়া শহরের আল আমিন মার্কেটে জননী গার্মেন্টসের বিক্রেতা বগুড়ার উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছিলেন, ‘বিএনপি আরেকবার ক্ষমতায় এলে বগুড়াকে দ্বিতীয় রাজধানী করবে। সরকারি-বেসরকারি এমন কোনো ব্যাংক নেই যার শাখা বগুড়াতে নেই।’ মোহাম্মদ আলী মিউজিয়াম অ্যান্ড পার্কের ভেতর ঢুকে দেখি তার জীর্ণদশা। ৩০ টাকা করে টিকিট হলেও সেখানে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। নবাববাড়ির যে সামান্য স্মৃতি সেখানে আছে, তারও যত্ন নেই। বগুড়ায় একটি চার তারকা হোটেল এবং আন্তর্জাতিক মানের শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম রয়েছে।
সার্কিট হাউসের পাশে রাস্তার ধারের এক ছোট্ট পানের দোকানের পাশে বসে পান বিক্রেতার সঙ্গে বগুড়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলছিলাম। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, বগুড়ায় বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীর কোনো খোঁজখবর রাখেনি। এমন সময়ে আওয়ামী লীগের এক সমর্থক সেখানে উপস্থিত হন। দুজনের মধ্যে বাগ্যুদ্ধ লেগে যায়। বাগ্বিতণ্ডার এক ফাঁকে পান বিক্রেতা বলেন, ‘শেখ হাসিনা যে বগুড়াকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করেননি, সেটা ভালোই হয়েছে। সিটি করপোরেশন ঘোষণা করলে সারা জীবন আওয়ামী লীগ বলত তারা সিটি দিছে।’ আওয়ামী লীগ সমর্থক বলছিলেন, ‘শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দিছে।’ বিএনপির সমর্থক একেবারেই বিশ্বাস করেন না যে বর্তমান সরকার বগুড়ার উন্নয়ন করবে। তবে এখন বগুড়াবাসীর দাবি বগুড়াকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হোক।
আওয়ামী লীগ বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি মমতাজ উদ্দীনের সঙ্গে কথা বললাম তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়ায় কয়েক দিন আগে আসছিলেন। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য এত লোক আসছিল যে এত লোক কোনো দিন বগুড়ার কোনো জনসভায় হয়নি। খালেদা জিয়ার জনসভাতেও না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিছে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হোইবে। আরও অনেক উন্নয়ন হোইবে।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তৌফিক হাসান। তিনি বগুড়া থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। বগুড়ার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘বগুড়ায় অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় কিন্তু সেগুলোর কোনো লক্ষ্য নেই। লক্ষ্য ঠিক করে অনুষ্ঠান করা উচিত।’ বগুড়া অঞ্চলের নিজস্ব কিছু লোককথা রয়েছে। সেগুলো তিনি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন।
বগুড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অনেক। শুধু বগুড়া জেলাতেই সরকারি কলেজের সংখ্যা ছয়টি। মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। হারম্যান মেইনার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া জিলা স্কুল, সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়সহ বেশ কটি ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বগুড়া শহরের উন্নয়নে যে সরকারই ভূমিকা রাখুক না কেন, সুবিধা ভোগ করছে বগুড়ার সর্বস্তরের নাগরিক।
একটি জেলা শহর হিসেবে বগুড়ায় যত ভৌত উন্নয়ন হয়েছে, দেশের আর কোনো জেলা শহরে এত উন্নয়ন হয়নি। উত্তরাঞ্চলের শিল্প রাজধানী বলে খ্যাত এ শহর। উন্নয়ন নিয়ে বগুড়াবাসীর মধ্যে তৃপ্তির ঢেকুর আছে, প্রত্যাশা আছে আরও উন্নয়নের। বিএনপির সময়ে তারেক রহমানের কাছে বগুড়া এবং আওয়ামী লীগের সময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রীর কাছে সিরাজগঞ্জ যেমন নিজ নিজ জেলা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক একইভাবে যদি তাঁরা ৬৪ জেলার প্রতি আন্তরিক হতেন, তাহলে উন্নয়নবৈষম্য সহজেই দূর হতো।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.