সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর নামে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য চলছে

সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর নামে শিক্ষাক্ষেত্রে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে বলে মনে করেন বক্তারা। তারা বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি ভালো। কিন্তু এটার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। এই পদ্ধতি চালুর পর থেকে শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। কাঁধে দু’টি ব্যাগ নিয়ে তারা নুইয়ে পড়ে। এত বইয়ের অত্যাচারে শিশুদের এক প্রকার নাভিশ্বাস উঠছে। তা ছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষকেরা কাসে ছাত্রছাত্রীদের ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কোনোভাবে কাস শেষ করেই কোচিংয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলা হচ্ছে তোমরা কোচিং সেন্টারে না গেলে পাস করতে পারবে না। শিক্ষকেরাও এই পদ্ধতি ভালোভাবে না বুঝতে পেরে দায়সারাভাবে কাস নিচ্ছেন। সৃজনশীলের গাইড পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। সেই গাইড বইকে সহজ করার জন্য আরো কিছু সহায়ক বই বের হয়েছে। এ রকমভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়াবহ বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
সোমবার ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশনের (রেস) উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবর্তিত সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। এটি রেসের প্রথম গবেষণা প্রতিবেদন। রেসের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো: শরিফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, নৃ-বিজ্ঞানী ড. জহির উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, সিনিয়র সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি, ড. মো: মোস্তাফিজুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ। এ ছাড়াও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার বাসাউরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রসেন কান্তি তালুকদার এবং রাজধানীর ধানমন্ডির মনেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা স্বপ্না পারভীন আলোচনায় অংশ নেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রেসের সদস্য ফৌজিয়া আক্তার রিনি। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণার ওপরে ছয় মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি সমস্যা নয়, সমস্যা হল এর প্রয়োগে। শিক্ষার নামে বাণিজ্য একটা মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য ও নৈরাজ্য চলছে, এটা সবাই জানে। সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে যদি সরকারের সদ্বিচ্ছা থাকতো তাহলে বেশি বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারত, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতো জরিপ করে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারত। বছরের শুরুতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারের বই উৎসবের তীব্র সমালোচনা করে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, মানব জাতির ইতিহাসে বাংলাদেশে একটি তামাশা দেখা যাচ্ছে বই উৎসব। পৃথিবীর কোথাও এ রকম দেখা যায় না। তিনি বলেন, বইয়ের আধিক্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। ফলে তারা আনন্দ তো দূরের কথা স্বাভাবিক অবস্থায়ও থাকতে পারে না। ভালো শিক্ষা না হলে ভালো কিছু আশা করা যায় না। শিক্ষাটা ভালো না করে জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার তা করা হচ্ছে। এ সময় তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সৃজনশীল পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে এই ধরনের একটি নতুন ও মৌলিক গবেষণার জন্য রেসকে ধন্যবাদ জানান।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বইয়ের আধিক্য অস্বাভাবিক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দেখে আমি কান্ত হই, চিন্তায় পড়ে যাই। এখনকার শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে চাপে রাখা হয় তাতে কেউ-ই সৃজনশীল হতে পারবেনা। তার চেয়ে বড় কথা হলো, শিশুদের এত বই পড়তে হবে কেন। এত জ্ঞানী কেন হতে হবে, কোচিং সেন্টারে যেতে হবে কেন, যদি কোচিংয়েই যেতে হয় তাহলে স্কুলের দরকার কী? সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে দিন বিদ্যালয়ে নতুন বই দেয়া হলো তার পরের দিন এক ছাত্র বলছে, গাইড বই কিনতে হবে। তার জন্য লাগবে তিন হাজার টাকা। শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্যটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে কিছু ব্যক্তি কিছু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিদর্শন করে এসে এটা চালু করেন। কিন্তু যে দেশে ৮০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক, শ্রেণীকক্ষ নেইÑ সেখানে মাল্টিমিডিয়া দিয়ে খুব একটা লাভ নেই। সরকার রাজনৈতিক কারণে পাসের হারের পেছনে দৌড়ায়। সেই সাথে চলছে ভয়ঙ্কর রকমের শিক্ষা বাণিজ্য। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।

No comments

Powered by Blogger.